ঢাকা ১২:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘কোটা’ বাতিলের আন্দোলনেই কি ফিরে আসছে নতুন কোটা?

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশঃ ০৯:৪৯:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
  • / 18

২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছবি: সংগৃহীত


মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের আহত ও নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসনকে ঘিরেই কি আবার নতুনভাবে ‘কোটা ব্যবস্থা’ ফিরে আসছে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০ দিনব্যাপী চলা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিহত ১৪০০ জন এবং আহত ১২ হাজার ৪৩ জনকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে সরকারি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে পরিচিত সেই আন্দোলনের নিহতদের ‘শহীদ’ এবং আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।

এর আওতায় আহত ও নিহতদের পরিবারের জন্য এককালীন অনুদান, মাসিক ভাতা, বিনামূল্যে চিকিৎসা, চাকরিতে অগ্রাধিকার ও ফ্ল্যাট সুবিধাসহ নানা পুনর্বাসন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৪০৫ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন ঢাকার আরিয়ান আহমেদ। সরকারি তালিকায় তাঁর নাম ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহত হিসেবে উঠেছে। ফলে এককালীন এক লাখ টাকা এবং মাসে ১০ হাজার টাকা পাবেন তিনি।

তবে আরিয়ান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যারা সত্যি সত্যি আহত, নিহত তাঁদের পরিবারকে ভাতা দেওয়া, চিকিৎসা সুবিধা—এসব একেবারে ঠিক আছে। কিন্তু চাকরিতে অগ্রাধিকার বা কোটা ফেরানো যুক্তিসঙ্গত কি না, সেটা ভেবে দেখা দরকার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সীমা আক্তারও ছিলেন এই আন্দোলনে। তিনি বলেন, ‘সবাই তো এক ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত না। অর্থনৈতিক অবস্থাও এক নয়। ফলে ভাতা ঠিক আছে, কিন্তু চাকরিতে অগ্রাধিকার, করছাড় বা ফ্ল্যাট সুবিধা আবার অন্যভাবে বৈষম্য তৈরি করবে না?’

আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অপব্যবহার হয়েছে, সেভাবেই ‘ভুয়া জুলাই যোদ্ধা’ তৈরি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে হাসপাতাল ও পুনর্বাসন সুবিধা ‘দখল’ করা বা ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দেশের অর্থ তো গুটিকয়েক মানুষের নয়। অথচ এই টাকা যাচ্ছে সবার করের টাকায়। শহীদ পরিবারকে সহায়তা জরুরি, কিন্তু সেটি যেন দীর্ঘমেয়াদে আবার নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণি না তৈরি করে।’

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলছেন, ‘এটি কোনো কোটা নয়। শহীদ ও আহতদের সংখ্যাও সীমিত। এটি এক প্রজন্মের জন্য পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতো নাতিপুতি পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

তবে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করেন, ‘একজন আহত বা নিহতের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেলে রাষ্ট্রকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে। এটি কোটা নয়, আর্থিক নিরাপত্তা।’

পুনর্বাসন নাকি নতুন বৈষম্য

নানামুখী সুবিধা বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে-

  • নিহত পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা এককালীন এবং মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা।

  • গুরুতর আহতদের ৫ লাখ টাকা এককালীন ও মাসে ২০ হাজার টাকা।

  • সরকারি হাসপাতালে আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা।

  • চাকরিতে অগ্রাধিকার।

  • সহজ শর্তে ঋণ ও ফ্ল্যাট সুবিধা।

তবে আন্দোলনের শুরুর দাবিই ছিল সব ধরনের কোটা বাতিলের। তাই আন্দোলনেরই ফসল হিসেবে এই সুবিধা প্যাকেজকে কেউ কেউ ‘পুনর্বাসন’ বললেও, অনেকে এটিকে নতুন রূপে কোটার ছায়া হিসেবেই দেখছেন।

অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ উমামা ফাতেমা বলেন, রাষ্ট্র পুনর্বাসন করছে এটা ভালো। কিন্তু কিভাবে করছে সেটাই বড় প্রশ্ন। সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের চেয়ে সরাসরি সুবিধা দেওয়ার এই পদ্ধতি আবার আলাদা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”

শেয়ার করুন

‘কোটা’ বাতিলের আন্দোলনেই কি ফিরে আসছে নতুন কোটা?

প্রকাশঃ ০৯:৪৯:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছবি: সংগৃহীত


মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের আহত ও নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসনকে ঘিরেই কি আবার নতুনভাবে ‘কোটা ব্যবস্থা’ ফিরে আসছে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০ দিনব্যাপী চলা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিহত ১৪০০ জন এবং আহত ১২ হাজার ৪৩ জনকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে সরকারি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে পরিচিত সেই আন্দোলনের নিহতদের ‘শহীদ’ এবং আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।

এর আওতায় আহত ও নিহতদের পরিবারের জন্য এককালীন অনুদান, মাসিক ভাতা, বিনামূল্যে চিকিৎসা, চাকরিতে অগ্রাধিকার ও ফ্ল্যাট সুবিধাসহ নানা পুনর্বাসন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৪০৫ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন ঢাকার আরিয়ান আহমেদ। সরকারি তালিকায় তাঁর নাম ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহত হিসেবে উঠেছে। ফলে এককালীন এক লাখ টাকা এবং মাসে ১০ হাজার টাকা পাবেন তিনি।

তবে আরিয়ান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যারা সত্যি সত্যি আহত, নিহত তাঁদের পরিবারকে ভাতা দেওয়া, চিকিৎসা সুবিধা—এসব একেবারে ঠিক আছে। কিন্তু চাকরিতে অগ্রাধিকার বা কোটা ফেরানো যুক্তিসঙ্গত কি না, সেটা ভেবে দেখা দরকার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সীমা আক্তারও ছিলেন এই আন্দোলনে। তিনি বলেন, ‘সবাই তো এক ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত না। অর্থনৈতিক অবস্থাও এক নয়। ফলে ভাতা ঠিক আছে, কিন্তু চাকরিতে অগ্রাধিকার, করছাড় বা ফ্ল্যাট সুবিধা আবার অন্যভাবে বৈষম্য তৈরি করবে না?’

আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অপব্যবহার হয়েছে, সেভাবেই ‘ভুয়া জুলাই যোদ্ধা’ তৈরি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে হাসপাতাল ও পুনর্বাসন সুবিধা ‘দখল’ করা বা ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দেশের অর্থ তো গুটিকয়েক মানুষের নয়। অথচ এই টাকা যাচ্ছে সবার করের টাকায়। শহীদ পরিবারকে সহায়তা জরুরি, কিন্তু সেটি যেন দীর্ঘমেয়াদে আবার নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণি না তৈরি করে।’

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলছেন, ‘এটি কোনো কোটা নয়। শহীদ ও আহতদের সংখ্যাও সীমিত। এটি এক প্রজন্মের জন্য পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতো নাতিপুতি পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

তবে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করেন, ‘একজন আহত বা নিহতের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেলে রাষ্ট্রকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে। এটি কোটা নয়, আর্থিক নিরাপত্তা।’

পুনর্বাসন নাকি নতুন বৈষম্য

নানামুখী সুবিধা বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে-

  • নিহত পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা এককালীন এবং মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা।

  • গুরুতর আহতদের ৫ লাখ টাকা এককালীন ও মাসে ২০ হাজার টাকা।

  • সরকারি হাসপাতালে আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা।

  • চাকরিতে অগ্রাধিকার।

  • সহজ শর্তে ঋণ ও ফ্ল্যাট সুবিধা।

তবে আন্দোলনের শুরুর দাবিই ছিল সব ধরনের কোটা বাতিলের। তাই আন্দোলনেরই ফসল হিসেবে এই সুবিধা প্যাকেজকে কেউ কেউ ‘পুনর্বাসন’ বললেও, অনেকে এটিকে নতুন রূপে কোটার ছায়া হিসেবেই দেখছেন।

অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ উমামা ফাতেমা বলেন, রাষ্ট্র পুনর্বাসন করছে এটা ভালো। কিন্তু কিভাবে করছে সেটাই বড় প্রশ্ন। সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের চেয়ে সরাসরি সুবিধা দেওয়ার এই পদ্ধতি আবার আলাদা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”