ঢাকা ১১:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসরায়েলিসহ একাধিক দেশের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন যে বাঙালি পাইলট

প্রজন্ম কথা ডেস্ক
  • প্রকাশঃ ০৪:৩৮:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
  • / 5

২০০১ সালে ‘লিভিং ইগল’ হিসেবে সাইফুলের নাম ইন্টারন্যাশনাল হল অব ফেম–এর অন্তর্ভুক্ত হয় ছবি: ছবি: সংগৃহীত । সূত্র: ইতিহাসবিদদের বই ও প্রাসঙ্গিক সামরিক নথি


আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ চলছে। চারপাশে তখন গোলার শব্দ আর গর্জে ওঠা যুদ্ধবিমান। একের পর এক আরব ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। ঠিক সেই সময় জর্ডানের আকাশ থেকে উড়ে আসা এক বাঙালি পাইলট গুলি ছুড়ে ভূপাতিত করেন ইসরায়েলের একটি যুদ্ধবিমান। ইতিহাসে জায়গা করে নেন তিনি সাইফুল আজম।

১৯৬৭ সালের সেই ছয় দিনের যুদ্ধে সাইফুল আজম চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন তিনটি ভিন্ন দেশের হয়ে যুদ্ধ করে। তখন তিনি ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এই বীর পাইলট।

১৯৬৭ সালের ৫ জুন বিকেলে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। উদ্দেশ্য ছিল, জর্ডানের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া। এর আগে মাত্র ৩০ মিনিটেই মিসরের দুই শতাধিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী।

কিন্তু মাফরাকে একই পরিণতি বরণ করতে হয়নি। কারণ, তখন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম জর্ডানের হয়ে লড়াই করছিলেন। জর্ডান বিমানবাহিনীর হান্টার জেট উড়িয়ে তিনি গুলি ছুড়ে ভূপাতিত করেন ইসরায়েলের একটি মিস্টেয়ার যুদ্ধবিমান।

মাফরাকের ওই হামলার পর ৭ জুন ইরাকের হয়ে আরেকটি মিশনে নামেন সাইফুল। ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলের মরুভূমির এইচ-থ্রি ঘাঁটিতে ইসরায়েলি বিমান হামলা ঠেকাতে আবারও উড়াল দেন তিনি। রাডারে শত্রু দেখেই এগিয়ে যান। একে একে দুইটি মিরাজ জেট ভূপাতিত করেন তিনি।

পরে পাকিস্তানের সাবেক এয়ার কমোডর কায়সার তুফায়েল তাঁর বই গ্রেট এয়ার ব্যাটলস অব পাকিস্তান এয়ার ফোর্স-এ লিখেছেন, সাইফুল আজমের সাহস ও ক্ষিপ্রতা এই অভিযানকে কিংবদন্তি করে তুলেছিল।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশন পান সাইফুল আজম। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমান ভূপাতিত করেন তিনি। ওই সাহসিকতার জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদকে ভূষিত করে।

এরপর পাকিস্তান থেকে তাঁকে জর্ডান বিমানবাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে পাঠানো হয়। জর্ডান বাদশাহ হুসেইন হামলার খবর পেয়ে নিজেই যুদ্ধরত পাইলটদের পাশে এসে দাঁড়ান। জর্ডান মিশনের পর সাইফুল আজমকে পাঠানো হয় ইরাকের হাবানিয়া ঘাঁটিতে। সেখানেই নতুন করে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর মুখোমুখি হন তিনি।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্য পাকিস্তান, জর্ডান ও ইরাক তিন দেশই তাঁকে সামরিক পদকে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে সাইফুল আজম যোগ দেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে। পরে জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

সাইফুল আজম ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল হল অব ফেম’-এ ‘লিভিং ইগল’ হিসেবে নাম ওঠে এই বীর বাঙালির ছবি: সংগৃহীত  


সাইফুল আজমের অসাধারণ নৈপুণ্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ইসরায়েলি পাইলটরাও। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শহীদুল ইনাম খানের লেখায় উঠে আসে, ‘‘১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলি এক পাইলটকে গুলি করে ভূপাতিত করার সময় সরাসরি না মেরে পাশ থেকে নিশানা করেছিলেন সাইফুল। শত্রুপাইলট প্যারাসুটে অবতরণ করেন।’’

যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে সম্মান দেখানোর এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ছয় দিনের যুদ্ধ শেষ হলেও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে তখন বড় বদল আসে। কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে থাকেন বাঙালি পাইলট সাইফুল আজম যিনি একাই চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে বিশ্বের আকাশযুদ্ধে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন সোনার অক্ষরে।

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”

শেয়ার করুন

ইসরায়েলিসহ একাধিক দেশের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন যে বাঙালি পাইলট

প্রকাশঃ ০৪:৩৮:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

২০০১ সালে ‘লিভিং ইগল’ হিসেবে সাইফুলের নাম ইন্টারন্যাশনাল হল অব ফেম–এর অন্তর্ভুক্ত হয় ছবি: ছবি: সংগৃহীত । সূত্র: ইতিহাসবিদদের বই ও প্রাসঙ্গিক সামরিক নথি


আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ চলছে। চারপাশে তখন গোলার শব্দ আর গর্জে ওঠা যুদ্ধবিমান। একের পর এক আরব ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। ঠিক সেই সময় জর্ডানের আকাশ থেকে উড়ে আসা এক বাঙালি পাইলট গুলি ছুড়ে ভূপাতিত করেন ইসরায়েলের একটি যুদ্ধবিমান। ইতিহাসে জায়গা করে নেন তিনি সাইফুল আজম।

১৯৬৭ সালের সেই ছয় দিনের যুদ্ধে সাইফুল আজম চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন তিনটি ভিন্ন দেশের হয়ে যুদ্ধ করে। তখন তিনি ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এই বীর পাইলট।

১৯৬৭ সালের ৫ জুন বিকেলে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। উদ্দেশ্য ছিল, জর্ডানের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া। এর আগে মাত্র ৩০ মিনিটেই মিসরের দুই শতাধিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী।

কিন্তু মাফরাকে একই পরিণতি বরণ করতে হয়নি। কারণ, তখন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম জর্ডানের হয়ে লড়াই করছিলেন। জর্ডান বিমানবাহিনীর হান্টার জেট উড়িয়ে তিনি গুলি ছুড়ে ভূপাতিত করেন ইসরায়েলের একটি মিস্টেয়ার যুদ্ধবিমান।

মাফরাকের ওই হামলার পর ৭ জুন ইরাকের হয়ে আরেকটি মিশনে নামেন সাইফুল। ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলের মরুভূমির এইচ-থ্রি ঘাঁটিতে ইসরায়েলি বিমান হামলা ঠেকাতে আবারও উড়াল দেন তিনি। রাডারে শত্রু দেখেই এগিয়ে যান। একে একে দুইটি মিরাজ জেট ভূপাতিত করেন তিনি।

পরে পাকিস্তানের সাবেক এয়ার কমোডর কায়সার তুফায়েল তাঁর বই গ্রেট এয়ার ব্যাটলস অব পাকিস্তান এয়ার ফোর্স-এ লিখেছেন, সাইফুল আজমের সাহস ও ক্ষিপ্রতা এই অভিযানকে কিংবদন্তি করে তুলেছিল।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশন পান সাইফুল আজম। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমান ভূপাতিত করেন তিনি। ওই সাহসিকতার জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদকে ভূষিত করে।

এরপর পাকিস্তান থেকে তাঁকে জর্ডান বিমানবাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে পাঠানো হয়। জর্ডান বাদশাহ হুসেইন হামলার খবর পেয়ে নিজেই যুদ্ধরত পাইলটদের পাশে এসে দাঁড়ান। জর্ডান মিশনের পর সাইফুল আজমকে পাঠানো হয় ইরাকের হাবানিয়া ঘাঁটিতে। সেখানেই নতুন করে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর মুখোমুখি হন তিনি।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্য পাকিস্তান, জর্ডান ও ইরাক তিন দেশই তাঁকে সামরিক পদকে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে সাইফুল আজম যোগ দেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে। পরে জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

সাইফুল আজম ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল হল অব ফেম’-এ ‘লিভিং ইগল’ হিসেবে নাম ওঠে এই বীর বাঙালির ছবি: সংগৃহীত  


সাইফুল আজমের অসাধারণ নৈপুণ্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ইসরায়েলি পাইলটরাও। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শহীদুল ইনাম খানের লেখায় উঠে আসে, ‘‘১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলি এক পাইলটকে গুলি করে ভূপাতিত করার সময় সরাসরি না মেরে পাশ থেকে নিশানা করেছিলেন সাইফুল। শত্রুপাইলট প্যারাসুটে অবতরণ করেন।’’

যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে সম্মান দেখানোর এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ছয় দিনের যুদ্ধ শেষ হলেও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে তখন বড় বদল আসে। কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে থাকেন বাঙালি পাইলট সাইফুল আজম যিনি একাই চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে বিশ্বের আকাশযুদ্ধে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন সোনার অক্ষরে।

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”