মুজিববাদ: একটি রাজনৈতিক বয়ানের পরিসমাপ্তি?

- প্রকাশঃ ১২:৩১:৫৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
- / 1
যেখানে একদা মুজিববাদের ঘাঁটি ছিল, সেখানেই আজ রাজনৈতিক আদর্শের পতনের ইতিহাস রচিত হলো | ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৬ জুলাই এই দিনটি নিছক আরেকটি সংঘাতময় দিন নয়, বরং এটি একটি বর্ণাঢ্য মতাদর্শিক অধ্যায়ের শেষ হওয়ার দিন। যে আদর্শকে ঘিরে স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে উঠেছিল, যার নামে গড়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক দানবীয় কাঠামো সেই মুজিববাদ আজ তার নিজস্ব জন্মভূমিতেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
গোপালগঞ্জ, যা একসময় ‘মুজিবভূমি’ নামে পরিচিত ছিল, ১৬ জুলাই সেখানে আওয়ামী লীগ এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ দফায় দফায় হামলার মধ্য দিয়ে একটি ভিন্ন বয়ানের উত্থান হয়েছে। এনসিপি’র পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের হামলা আর পুলিশের সহিংসতা শুধু রাজনৈতিক সংঘাত নয়, বরং এটি একটি পরিস্কার বার্তা ক্ষমতার জোরে যে আদর্শ রক্ষা করা হয়, তা আদর্শ নয়, তা ভয়ভিত্তিক কর্তৃত্ববাদ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ন্যারেটিভ’ বা বয়ান একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি রাজনৈতিক দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে একটি গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী ন্যারেটিভ থাকা জরুরি। যেমন বিএনপির ক্ষেত্রে ‘জাতীয়তাবাদী’ বয়ান, যা জিয়াউর রহমানের ভাবনা থেকে উৎসারিত। এ বয়ান তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের ভিত্তি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ‘মুজিববাদ’ আজ আর সেই ন্যারেটিভের শক্তি ধরে রাখতে পারছে না।
একাত্তরের চেতনা, শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক নেতৃত্ব এসব আদর্শ একসময় গণমানুষের আবেগের সঙ্গে একাত্ম ছিল। কিন্তু বিগত ১৫ থেকে ১৬ বছরের শাসনামলে এই আদর্শকে রাজনৈতিক পণ্যে রূপান্তর করা হয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ’ এই শব্দবন্ধটি হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষ দমন ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার।
মুজিববাদকে ঘিরে তৈরি করা ন্যারেটিভ আজ আর জনমানুষের কাছে আবেগ তৈরি করে না। বরং তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ, পুরাতন, ছেঁড়া পোস্টারের মতো ছিন্নভিন্ন। সময় বদলেছে, মানুষ বদলেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাষ্য বদলায়নি। ফলাফল তাদের বয়ান এখন ধুলোবালি হয়ে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে।
গোপালগঞ্জে নতুন দল এনসিপি ওপর হামলা, স্বৈরাচারী মনোভাব এবং দমন-পীড়নের চর্চা এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে মুজিববাদ আর রাজনৈতিক মাঠে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। আজকের ঘটনাটি এই মতাদর্শিক পতনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এখন সময় নতুন বয়ানের, নতুন রাজনৈতিক ভাবনার। বাংলাদেশের মানুষ চায় বিশ্বাসযোগ্যতা, অংশগ্রহণ, এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার নিশ্চয়তা। একদলীয় আধিপত্য, পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভাবনা, এবং ‘চেতনা বিক্রয়’ এর যুগ শেষ হয়েছে।
মুজিববাদ একটি ইতিহাস, কিন্তু ইতিহাসকে বারবার ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব নয়।