ঢাকা ০৪:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খাদ্যে ও ঔষধে ভেজাল: প্রতিকার এবং করণীয়

গোলাম মোস্তফা
  • প্রকাশঃ ০৬:৩৩:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫
  • / 22

ছবি: প্রজন্ম কথা 


খাদ্য ও ওষুধ মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সুস্থ দেহ ও মনের জন্য যেমন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য অপরিহার্য, তেমনি রোগমুক্ত থাকার জন্য মানসম্মত ওষুধ অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের সমাজে খাদ্যে ভেজাল এবং ওষুধে প্রতারণা এক মারাত্মক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এই ভেজাল ও প্রতারণা মানুষের স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করছে, কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং একটি সুস্থ জাতি গঠনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাজারে গেলে প্রায় সব ধরনের খাদ্যে ভেজালের চিত্র স্পষ্ট। দুধে মেশানো হয় কেমিক্যাল, শাকসবজিতে প্রয়োগ করা হয় ক্ষতিকর রঙ, ফল ও মাছ টাটকা রাখার জন্য দেওয়া হয় ফরমালিন। এমনকি মিষ্টি, পানীয় কিংবা শিশুখাদ্যেও মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক। এসব ভেজাল দ্রব্য সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, লিভারের জটিলতা, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখের জন্ম দেয়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, গর্ভবতী মা ও নবজাতক ঝুঁকিতে পড়ে এবং সুস্থ জাতি গঠনের ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়।

শুধু খাদ্য নয়, ওষুধেও প্রতারণার ভয়াবহতা রয়েছে। বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে নকল ও নিম্নমানের ওষুধ। অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি করে বাজারজাত করছে। অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে নতুন লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হয়। ফলে রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে রোগীর জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ভুয়া ডাক্তার ও নকল ওষুধ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। রোগীরা কম দামের লোভে এসব ওষুধ কিনে ব্যবহার করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ভোগান্তিই বাড়ে।

খাদ্যে ভেজাল ও ওষুধে প্রতারণার কারণে সমাজে নানা ধরনের জটিল রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যান্সার, হৃদরোগ, হরমোনজনিত অসামঞ্জস্য, শিশুদের শারীরিক বিকাশের সমস্যা এবং অকালমৃত্যুর মতো বিপর্যয় ঘটছে। এতে শুধু পরিবার নয়, সমগ্র জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পড়ছে, ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে কার্যকর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমত, খাদ্য ও ওষুধ ভেজালের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দৃশ্যমান না হলে এ প্রবণতা কমবে না। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি জেলায় আধুনিক মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে, যাতে বাজারজাত করার আগে পণ্যের গুণগত মান যাচাই করা সম্ভব হয়। তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে মানুষকে সচেতন করতে উদ্যোগ নিতে হবে, যেন তারা ভেজাল খাদ্য ও নকল ওষুধ চিনতে পারে এবং সেগুলো এড়িয়ে চলতে পারে।

এ ছাড়া কৃষকদের জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহিত করা উচিত, যাতে প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে। ফরমালিন ও কেমিক্যাল ছাড়া খাদ্য সংরক্ষণের আধুনিক প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে হবে। ব্যবসায়ী সমাজকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে, কারণ ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকেও ভেজাল একটি গুরুতর পাপ। মানুষ যদি ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ অনুসরণ করে, তবে অনেকাংশে এ অপরাধ কমে যাবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সক্রিয় হতে হবে। ভোক্তারা যদি ভেজাল পণ্য কিনতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা কমে যাবে এবং উৎপাদকরা বাধ্য হবে সৎ পথে আসতে।

সবশেষে বলা যায়, খাদ্যে ভেজাল ও ওষুধে প্রতারণা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, বরং একটি জাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। সুস্থ ও কর্মক্ষম জাতি গড়তে হলে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সরকার, প্রশাসন, ব্যবসায়ী সমাজ ও সাধারণ জনগণ—সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

-গোলাম মোস্তফা, ফিচার্স রাইটার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”

শেয়ার করুন

খাদ্যে ও ঔষধে ভেজাল: প্রতিকার এবং করণীয়

প্রকাশঃ ০৬:৩৩:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

ছবি: প্রজন্ম কথা 


খাদ্য ও ওষুধ মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সুস্থ দেহ ও মনের জন্য যেমন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য অপরিহার্য, তেমনি রোগমুক্ত থাকার জন্য মানসম্মত ওষুধ অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের সমাজে খাদ্যে ভেজাল এবং ওষুধে প্রতারণা এক মারাত্মক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এই ভেজাল ও প্রতারণা মানুষের স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করছে, কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং একটি সুস্থ জাতি গঠনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাজারে গেলে প্রায় সব ধরনের খাদ্যে ভেজালের চিত্র স্পষ্ট। দুধে মেশানো হয় কেমিক্যাল, শাকসবজিতে প্রয়োগ করা হয় ক্ষতিকর রঙ, ফল ও মাছ টাটকা রাখার জন্য দেওয়া হয় ফরমালিন। এমনকি মিষ্টি, পানীয় কিংবা শিশুখাদ্যেও মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক। এসব ভেজাল দ্রব্য সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, লিভারের জটিলতা, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখের জন্ম দেয়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, গর্ভবতী মা ও নবজাতক ঝুঁকিতে পড়ে এবং সুস্থ জাতি গঠনের ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়।

শুধু খাদ্য নয়, ওষুধেও প্রতারণার ভয়াবহতা রয়েছে। বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে নকল ও নিম্নমানের ওষুধ। অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি করে বাজারজাত করছে। অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে নতুন লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হয়। ফলে রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে রোগীর জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ভুয়া ডাক্তার ও নকল ওষুধ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। রোগীরা কম দামের লোভে এসব ওষুধ কিনে ব্যবহার করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ভোগান্তিই বাড়ে।

খাদ্যে ভেজাল ও ওষুধে প্রতারণার কারণে সমাজে নানা ধরনের জটিল রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যান্সার, হৃদরোগ, হরমোনজনিত অসামঞ্জস্য, শিশুদের শারীরিক বিকাশের সমস্যা এবং অকালমৃত্যুর মতো বিপর্যয় ঘটছে। এতে শুধু পরিবার নয়, সমগ্র জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পড়ছে, ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে কার্যকর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমত, খাদ্য ও ওষুধ ভেজালের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দৃশ্যমান না হলে এ প্রবণতা কমবে না। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি জেলায় আধুনিক মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে, যাতে বাজারজাত করার আগে পণ্যের গুণগত মান যাচাই করা সম্ভব হয়। তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে মানুষকে সচেতন করতে উদ্যোগ নিতে হবে, যেন তারা ভেজাল খাদ্য ও নকল ওষুধ চিনতে পারে এবং সেগুলো এড়িয়ে চলতে পারে।

এ ছাড়া কৃষকদের জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহিত করা উচিত, যাতে প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে। ফরমালিন ও কেমিক্যাল ছাড়া খাদ্য সংরক্ষণের আধুনিক প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে হবে। ব্যবসায়ী সমাজকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে, কারণ ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকেও ভেজাল একটি গুরুতর পাপ। মানুষ যদি ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ অনুসরণ করে, তবে অনেকাংশে এ অপরাধ কমে যাবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সক্রিয় হতে হবে। ভোক্তারা যদি ভেজাল পণ্য কিনতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা কমে যাবে এবং উৎপাদকরা বাধ্য হবে সৎ পথে আসতে।

সবশেষে বলা যায়, খাদ্যে ভেজাল ও ওষুধে প্রতারণা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, বরং একটি জাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। সুস্থ ও কর্মক্ষম জাতি গড়তে হলে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সরকার, প্রশাসন, ব্যবসায়ী সমাজ ও সাধারণ জনগণ—সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

-গোলাম মোস্তফা, ফিচার্স রাইটার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”