ঢাকা ০১:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দিকহারা কোচে দিশেহারা ফুটবল, কাবরেরার সিদ্ধান্তে ডুবতে বসেছে নবজাগরণের স্বপ্ন

রামিন তালুকদার
  • প্রকাশঃ ০২:৩৫:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫
  • / 18

হংকংয়ের বিপক্ষে হার শুধু মাঠে নয়, ভেঙে দিয়েছে সমর্থকদের ভরসাও | ছবি: সংগৃহীত


স্টেডিয়ামের মূল ফটকের কাছে তখন ছোট্ট এক জটলা, যেন কোনো বিক্ষুব্ধ জনতার শেষ আশ্রয়। হালকা বাতাসে ফুটবলের রোমাঞ্চের গন্ধ। কিন্তু সেই গন্ধে মিশে আছে একরাশ ক্ষোভ, একচিলতে হতাশা। কয়েকজন তরুণ একসঙ্গে চিৎকার করছে, কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ ঘুষি মারছে, কেউবা চোখের জল লুকোচ্ছে অন্ধকারে।

কাছাকাছি যেতেই বোঝা গেল, এরা একে অপরের শত্রু নয়, বরং একই পতাকার প্রেমে ডুবে থাকা বন্ধু। কিন্তু যাদের ওপর আঘাত ঝরছে, তাদের অপরাধ শুধু এই, তাদের নাম ফাহিম ও সাদ।

একজন গোল খাইয়েছেন, আরেকজন গোল হংকংকে উপহার দিয়েছেন। যেন মাঠের ব্যর্থতা এসে থেমেছে গ্যালারির গলিতে, বন্ধুত্বের বুকেও ঢুকেছে হতাশার ঘা।

আর একটু সামনে গেলেই দেখা যায়, একদল সমর্থক টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ‘ভুয়া! ভুয়া!’

কাকে বলা হচ্ছে? উত্তরটা পেতে সময় লাগল না। তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। তাদের কণ্ঠে ক্ষোভ, ব্যথা আর অচলাবস্থার প্রতিধ্বনি, ‘এই কোচ যতদিন থাকবে, আমরা মাঠে আসব না!’

কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি তারা আর আসবেন না?

যদি না-ও আসেন, তাহলে কি আবারো ফুটবল ডুবে যাবে হতাশার অতলে?

এই হতাশার পটভূমি যদি এক বছর পেছনে ফিরিয়ে দেখা যায়, দেখা যাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্য। বাংলাদেশের ফুটবল তখন নব্বই দশকের হারানো গৌরবের মতো মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। মানুষের মনে আবারও ফুটবল নামের ভালোবাসা জেগে উঠছিল নতুন করে।

তার সূচনা হয়েছিল এক ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মাঠ থেকে -যেখানে জন্ম, বেড়ে ওঠা, আর জীবন কাটানো হামজা চৌধুরী লাল-সবুজের পতাকা বেছে নিলেন নিজের হৃদয়ের টানেই। সেই মুহূর্তে যেন গোটা জাতির হৃদয় থমকে গিয়েছিল। বিদেশের ঘাস ছুঁয়ে বড় হওয়া এক তরুণ ঘোষণা করলেন, ‘আমি বাংলাদেশ।’

তারপর যখন কানাডা প্রবাসী মিডফিল্ডার শমিত সোমও সেই একই সিদ্ধান্ত নিলেন, ফুটবল যেন নতুন করে শ্বাস নিতে শুরু করল। তরুণ প্রজন্মে উচ্ছ্বাসের ঢেউ -সোশ্যাল মিডিয়ায়, চায়ের দোকানে, গলির রাস্তায়, সর্বত্র আলোচনার ঝড়। মানুষ ভাবল, এবার হয়তো ফুটবলের সেই প্রাণ ফিরে আসছে, যা একসময় হাজারো ভক্তের বুকভরা গর্ব ছিল।

এরপর সেই এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ, যা ছিল রীতিমতো এক উৎসব। স্টেডিয়ামের গেট খুলতেই জনতার স্রোত উপচে পড়ছে। ভেতরে যত মানুষ, বাইরে তার দ্বিগুণ।

পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন, কিন্তু মানুষের মুখে শুধু একটাই শব্দ, ‘বাংলাদেশ!’

কিন্তু ফুটবল নামের খেলা যে কেবল আবেগে জেতা যায় না, সেটা সবাই সেদিন বুঝেছিল। ম্যাচ শেষে ফলাফলের কাগজে বাংলাদেশ হারল, তবে তার সঙ্গে হারিয়েছিল অনেক কিছুই -ভরসা, আস্থা, দিকনির্দেশনা। যদিও সমর্থকরা সেইদিন রেফারির উপর রাগ উগড়ে দিয়েছিলেন। তার কিছু সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত, নিশ্চিত পেনাল্টিও দেননি তিনি।

আর যারা খেলার ভেতরটা দেখেছেন, তারা সরব হয়ে জানালেন, সেদিন হারার মূল কারণ ছিল অন্য কোথাও। কোচ কাবরেরা যেন খেলাটিকে এক অদ্ভুত পরীক্ষাগারে পরিণত করেছিলেন। যেখানে খেলোয়াড়েরা হয়ে উঠেছিলেন তার ব্যর্থ কৌশলের পরীক্ষার বস্তু।

তবে সেদিনের শিক্ষা থেকেও যেন কিছু শেখেননি কাবরেরা। আজ হংকং, চায়নার বিপক্ষে ম্যাচে তিনি যেন নিজেই নিজের সমালোচককে প্রমাণ করতে উঠে পড়েছিলেন। গত কয়েক বছরের প্রতিটি ব্যর্থতায় যে নামটি বারবার এসেছে, সেই সাদ উদ্দিনকে আবারও লেফট ব্যাকে নামালেন তিনি। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সেশেলস, কোথায় কোথায় না এই সাদের ভুলে ভেঙে গেছে জয়ের স্বপ্ন!

অথচ মাঠের বাইরে বসে ছিলেন এক তরুণ, জায়ান আহমেদ। যিনি কদিন আগেই বয়সভিত্তিক দলে প্রমাণ করেছিলেন নিজেকে। শেষ দিকে যখন তাকে মাঠে নামানো হলো, খেলার চিত্র তখন থেকেই পাল্টে গেল। দুই গোলে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ ফিরে এল সমতায়। গ্যালারি জেগে উঠল নতুন আশায়।

কিন্তু সেই আশার কুঁড়িতে আবারো পা রাখলেন সেই সাদ -আরেকটি ভুল, আরেকটি পাস, আরেকটি বিপর্যয়। মার্কিসের পায়ে তুলে দিলেন বল, এবং সেই বল থেকেই এল হংকংয়ের জয়সূচক গোল। স্টেডিয়ামে তখন একরাশ স্তব্ধতা।

দূরে বসে এক সমর্থক হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন, ‘হংকং নয়, গোলটা আসলে মেরেছেন কাবরেরাই।’

যেখানে সিঙ্গাপুর ম্যাচে শমিত সোম ছিলেন সেরা পারফর্মার, সেই শমিতকেই এবার বেঞ্চে বসিয়ে খেলানো হলো সোহেল রানাকে। যিনি প্রতিপক্ষকে একটি গোল উপহার দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। ফাহামিদুলের জায়গায় ফাহিম, তারও একই গল্প। যিনি প্রতিপক্ষকে উপহার দিয়েছিলেন প্রথম গোল। একবার নয়, বারবার এমন সিদ্ধান্ত যেন কাবরেরার এক ব্যক্তিগত পরীক্ষার অংশ।

তবু সবচেয়ে দৃষ্টিকটু মুহূর্তটি ছিল সাদ উদ্দিনের ‘নাটমেগ’ হওয়া। ডিফেন্ডারের দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে বল নিয়ে গেলেন এভারটন। যা থেকে হ্যাটট্রিকের দ্বিতীয় গোল পান মার্কিস। পরে যখন শমিত সোমের গোলে বাংলাদেশ সমতায় ফেরে, তখনও সাদই আবার বল হারান সেই মার্কিসের কাছে। এবং, সেখানেই ঠুকে গেল শেষ পেরেক।

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”

শেয়ার করুন

দিকহারা কোচে দিশেহারা ফুটবল, কাবরেরার সিদ্ধান্তে ডুবতে বসেছে নবজাগরণের স্বপ্ন

প্রকাশঃ ০২:৩৫:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

হংকংয়ের বিপক্ষে হার শুধু মাঠে নয়, ভেঙে দিয়েছে সমর্থকদের ভরসাও | ছবি: সংগৃহীত


স্টেডিয়ামের মূল ফটকের কাছে তখন ছোট্ট এক জটলা, যেন কোনো বিক্ষুব্ধ জনতার শেষ আশ্রয়। হালকা বাতাসে ফুটবলের রোমাঞ্চের গন্ধ। কিন্তু সেই গন্ধে মিশে আছে একরাশ ক্ষোভ, একচিলতে হতাশা। কয়েকজন তরুণ একসঙ্গে চিৎকার করছে, কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ ঘুষি মারছে, কেউবা চোখের জল লুকোচ্ছে অন্ধকারে।

কাছাকাছি যেতেই বোঝা গেল, এরা একে অপরের শত্রু নয়, বরং একই পতাকার প্রেমে ডুবে থাকা বন্ধু। কিন্তু যাদের ওপর আঘাত ঝরছে, তাদের অপরাধ শুধু এই, তাদের নাম ফাহিম ও সাদ।

একজন গোল খাইয়েছেন, আরেকজন গোল হংকংকে উপহার দিয়েছেন। যেন মাঠের ব্যর্থতা এসে থেমেছে গ্যালারির গলিতে, বন্ধুত্বের বুকেও ঢুকেছে হতাশার ঘা।

আর একটু সামনে গেলেই দেখা যায়, একদল সমর্থক টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ‘ভুয়া! ভুয়া!’

কাকে বলা হচ্ছে? উত্তরটা পেতে সময় লাগল না। তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। তাদের কণ্ঠে ক্ষোভ, ব্যথা আর অচলাবস্থার প্রতিধ্বনি, ‘এই কোচ যতদিন থাকবে, আমরা মাঠে আসব না!’

কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি তারা আর আসবেন না?

যদি না-ও আসেন, তাহলে কি আবারো ফুটবল ডুবে যাবে হতাশার অতলে?

এই হতাশার পটভূমি যদি এক বছর পেছনে ফিরিয়ে দেখা যায়, দেখা যাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্য। বাংলাদেশের ফুটবল তখন নব্বই দশকের হারানো গৌরবের মতো মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। মানুষের মনে আবারও ফুটবল নামের ভালোবাসা জেগে উঠছিল নতুন করে।

তার সূচনা হয়েছিল এক ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মাঠ থেকে -যেখানে জন্ম, বেড়ে ওঠা, আর জীবন কাটানো হামজা চৌধুরী লাল-সবুজের পতাকা বেছে নিলেন নিজের হৃদয়ের টানেই। সেই মুহূর্তে যেন গোটা জাতির হৃদয় থমকে গিয়েছিল। বিদেশের ঘাস ছুঁয়ে বড় হওয়া এক তরুণ ঘোষণা করলেন, ‘আমি বাংলাদেশ।’

তারপর যখন কানাডা প্রবাসী মিডফিল্ডার শমিত সোমও সেই একই সিদ্ধান্ত নিলেন, ফুটবল যেন নতুন করে শ্বাস নিতে শুরু করল। তরুণ প্রজন্মে উচ্ছ্বাসের ঢেউ -সোশ্যাল মিডিয়ায়, চায়ের দোকানে, গলির রাস্তায়, সর্বত্র আলোচনার ঝড়। মানুষ ভাবল, এবার হয়তো ফুটবলের সেই প্রাণ ফিরে আসছে, যা একসময় হাজারো ভক্তের বুকভরা গর্ব ছিল।

এরপর সেই এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ, যা ছিল রীতিমতো এক উৎসব। স্টেডিয়ামের গেট খুলতেই জনতার স্রোত উপচে পড়ছে। ভেতরে যত মানুষ, বাইরে তার দ্বিগুণ।

পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন, কিন্তু মানুষের মুখে শুধু একটাই শব্দ, ‘বাংলাদেশ!’

কিন্তু ফুটবল নামের খেলা যে কেবল আবেগে জেতা যায় না, সেটা সবাই সেদিন বুঝেছিল। ম্যাচ শেষে ফলাফলের কাগজে বাংলাদেশ হারল, তবে তার সঙ্গে হারিয়েছিল অনেক কিছুই -ভরসা, আস্থা, দিকনির্দেশনা। যদিও সমর্থকরা সেইদিন রেফারির উপর রাগ উগড়ে দিয়েছিলেন। তার কিছু সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত, নিশ্চিত পেনাল্টিও দেননি তিনি।

আর যারা খেলার ভেতরটা দেখেছেন, তারা সরব হয়ে জানালেন, সেদিন হারার মূল কারণ ছিল অন্য কোথাও। কোচ কাবরেরা যেন খেলাটিকে এক অদ্ভুত পরীক্ষাগারে পরিণত করেছিলেন। যেখানে খেলোয়াড়েরা হয়ে উঠেছিলেন তার ব্যর্থ কৌশলের পরীক্ষার বস্তু।

তবে সেদিনের শিক্ষা থেকেও যেন কিছু শেখেননি কাবরেরা। আজ হংকং, চায়নার বিপক্ষে ম্যাচে তিনি যেন নিজেই নিজের সমালোচককে প্রমাণ করতে উঠে পড়েছিলেন। গত কয়েক বছরের প্রতিটি ব্যর্থতায় যে নামটি বারবার এসেছে, সেই সাদ উদ্দিনকে আবারও লেফট ব্যাকে নামালেন তিনি। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সেশেলস, কোথায় কোথায় না এই সাদের ভুলে ভেঙে গেছে জয়ের স্বপ্ন!

অথচ মাঠের বাইরে বসে ছিলেন এক তরুণ, জায়ান আহমেদ। যিনি কদিন আগেই বয়সভিত্তিক দলে প্রমাণ করেছিলেন নিজেকে। শেষ দিকে যখন তাকে মাঠে নামানো হলো, খেলার চিত্র তখন থেকেই পাল্টে গেল। দুই গোলে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ ফিরে এল সমতায়। গ্যালারি জেগে উঠল নতুন আশায়।

কিন্তু সেই আশার কুঁড়িতে আবারো পা রাখলেন সেই সাদ -আরেকটি ভুল, আরেকটি পাস, আরেকটি বিপর্যয়। মার্কিসের পায়ে তুলে দিলেন বল, এবং সেই বল থেকেই এল হংকংয়ের জয়সূচক গোল। স্টেডিয়ামে তখন একরাশ স্তব্ধতা।

দূরে বসে এক সমর্থক হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন, ‘হংকং নয়, গোলটা আসলে মেরেছেন কাবরেরাই।’

যেখানে সিঙ্গাপুর ম্যাচে শমিত সোম ছিলেন সেরা পারফর্মার, সেই শমিতকেই এবার বেঞ্চে বসিয়ে খেলানো হলো সোহেল রানাকে। যিনি প্রতিপক্ষকে একটি গোল উপহার দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। ফাহামিদুলের জায়গায় ফাহিম, তারও একই গল্প। যিনি প্রতিপক্ষকে উপহার দিয়েছিলেন প্রথম গোল। একবার নয়, বারবার এমন সিদ্ধান্ত যেন কাবরেরার এক ব্যক্তিগত পরীক্ষার অংশ।

তবু সবচেয়ে দৃষ্টিকটু মুহূর্তটি ছিল সাদ উদ্দিনের ‘নাটমেগ’ হওয়া। ডিফেন্ডারের দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে বল নিয়ে গেলেন এভারটন। যা থেকে হ্যাটট্রিকের দ্বিতীয় গোল পান মার্কিস। পরে যখন শমিত সোমের গোলে বাংলাদেশ সমতায় ফেরে, তখনও সাদই আবার বল হারান সেই মার্কিসের কাছে। এবং, সেখানেই ঠুকে গেল শেষ পেরেক।

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”