মাজার নিয়ে বিতর্ক : শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি

- প্রকাশঃ ০২:০৭:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
- / 19
ছবি: প্রজন্ম কথা
বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বে অলি-আউলিয়াগণের মাজারকে ঘিরে মানুষের আবেগ ও শ্রদ্ধা সুপ্রাচীন। তবে প্রায়ই একটি প্রশ্ন ওঠে—মাজারের উপর ইমারত বা গম্বুজ নির্মাণ কি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ?
কুরআন-হাদিস ও ইসলামী ফকীহদের আলোচনায় এর উত্তর স্পষ্ট। কুরআনে আসহাবে কাহাফের ঘটনার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—“তখন তারা কিছু লোক বলল—‘তাদের উপর একটি স্থাপনা বানাও, তাদের রবই তাদের সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন।’ কিন্তু যারা তাদের ব্যাপারে প্রভাবশালী ছিল তারা বলল—‘আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে একটি মসজিদ বানাবো।’ (সূরা কাহফ, আয়াত ২১)।
এতে বোঝা যায়, নেক বান্দাদের কবরকে কেন্দ্র করে স্থাপনা নির্মাণ শরীয়তের অনুমোদিত কাজ।
হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সাঃ) হযরত উসমান ইবনে মযঊনের (রা.) কবর চিহ্নিত করতে একটি পাথর বসিয়েছিলেন (আবু দাউদ)। সাহাবায়ে কিরামও কবর উঁচু করে দৃষ্টিগোচর রাখতেন। ফিকহি গ্রন্থ ফতওয়ায়ে শামী ও দুররুল মুখতারসহ নির্ভরযোগ্য সূত্রে বলা হয়েছে—আলেম, বুযুর্গ ও নেককারদের কবরের উপর ইমারত নির্মাণ করা মাকরূহ নয়। এ থেকে বোঝা যায় নেককারদের কবরের উপর ইমারত নির্মাণ শরীয়ত সম্মত।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবী করিম (সাঃ) এঁর রওজা মুবারক এবং বহু সাহাবি ও তাবেয়ীর মাজার শরীফ গম্বুজ ও প্রাচীর দ্বারা সংরক্ষিত হয়েছে। এতে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত রাখে।
ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের (ওলী-আল্লাহ) বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত। তারা আল্লাহর জিকিরে অন্তরকে আলোকিত করে নেন, দুনিয়ার মোহমায়া থেকে দূরে থেকে আধ্যাত্মিক জীবনের পথে চলেন। সমাজে আল্লাহর আউলিয়াগণের অবস্থান আলাদা, কারণ তারা আল্লাহর রহমতের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে তাদের মাজার নিয়ে মুসলিম সমাজে সম্মান ও শ্রদ্ধার একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে।
কুরআন-হাদিস ও ইসলামী শিক্ষার আলোকে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হল—
আল্লাহর অলিগনের পরিচয়ঃ
কুরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেন— “জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর ওলিদের কোনো ভয় নেই, তাদের কোনো দুঃখও নেই। তারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে।” (সূরা ইউনুস: আয়াত: ৬২-৬৩) (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৬৯)।
“আর তুমি কখনোই তাদের মৃত গণ্য করো না, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে; বরং তারা জীবিত, তাদের প্রভুর নিকটে রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছে।” (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৭০)।
“আল্লাহ তাদের যে অনুগ্রহ দান করেছেন, তাতে তারা আনন্দিত; আর যারা এখনও তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি, তাদের প্রতিও তারা সুসংবাদ প্রেরণ করে যে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”
অতএব, আল্লাহর ওলী হচ্ছেন সেই বান্দারা যাদের অন্তর সদা জিকিরে উজ্জ্বল, ঈমান ও তাকওয়ার আলোয় আলোকিত।
নবী করিম (সাঃ) এঁর হাদিসে এসেছে— “আল্লাহর কিছু বান্দা আছেন, তারা নবী নন, শহীদও নন; অথচ কেয়ামতের দিন নবী ও শহীদগণ তাদের মর্যাদা দেখে হিংসা করবেন।” (মুসনাদে আহমদ)।
তাদের হৃদয় জিকিরের মাধ্যমে নূরানী হয়, এবং তারা আল্লাহর দরবারে সম্মানিত। তাঁদের দোয়া কবুল হয়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন— “অনেক মানুষ আছে যাদের পোশাক মলিন, দরজার বাইরে থেকে ফেরত দেওয়া হয়; কিন্তু তারা যদি আল্লাহর কাছে কসম করে কিছু চায়, আল্লাহ তা পূর্ণ করেন।” (বুখারী, মুসলিম) এ থেকেই স্পষ্ট হয় যে, ওলী-আল্লাহর দোয়া আল্লাহর দরবারে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। তাই মুসলমানরা তাঁদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করে, এবং তাঁদের মাধ্যমে রহমত লাভের আশায় মাজারে যায়।
সমাজে তাঁদের মর্যাদাঃ ওলী-আল্লাহদের সমাজ সাধারণ মানুষের সমাজের মতো নয়। তাদের অন্তর আল্লাহর ভালোবাসায় এমনভাবে ভরে যায় যে, তারা দুনিয়ার মোহে ডুবে থাকেন না। কুরআনে আল্লাহ বলেন— “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা উঁচু মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (সূরা আন‘আম: ৮৩)
অতএব, যাদের আল্লাহ নিজে সম্মানিত করেছেন, তাঁদেরকে সম্মান করা মানেই আল্লাহর নির্দেশ মানা। তাই তাঁদের মর্যাদায় মাজারে স্থাপনা বা ইমারত নির্মাণ শরীয়ত পরিপন্থী নয় বরং শরীয়ত সম্মত।মাজারের মর্যাদাঃ নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, “নবীগণ রওজার মধ্যেও জীবিত, তাঁরা নামাজ পড়েন।” (আবু ইয়ালা, বায়হাকি)।মহান আল্লাহ পাক আরো বলেন, “জেনে রাখো! আল্লাহর ওলিদের কোনো ভয় নেই, আর তারা দুঃখিতও হবে না।
তারা তারাই, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে।
তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে দুনিয়ার জীবনেও এবং আখিরাতেও। আল্লাহর বাণী পরিবর্তনযোগ্য নয়। এটাই হলো মহাসাফল্য।”
সূরা ইউনুস, আয়াত ৬২-৬৪
ইন্তেকালের পর আল্লাহর ওলিগণের মাজারও আল্লাহপাকের রহমতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে।
অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারতের অনুমতি দিলাম, কেননা এটি আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসলিম)
অতএব, কবর জিয়ারত সুন্নত, আর নেক বান্দাদের মাজারকে সম্মান জানানো বৈধ, কল্যাণকর এবং শরীয়ত সম্মত।
আল্লাহর আউলিয়াগণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তাঁদের অন্তর নূরানী হয় আল্লাহর জিকিরে। তাঁদের দোয়া কবুল হয়, তাঁদের মর্যাদা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত। তাই তাঁদের মাজারকে অসম্মান করা বা দোষারোপ করা শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং তাঁদের মাজার আমাদের জন্য স্মরণ, শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের মাধ্যম।
আল্লাহ যাদের ভালোবাসেন, তাঁদের ভালোবাসা ও সম্মান করা আসলে আল্লাহকেই ভালোবাসা। আর তাঁদের মাজারকে সম্মান করা মানে ইসলামী ঐতিহ্য ও ইতিহাস সংরক্ষণ করা।
নবী-রাসূলগণ, আহলে বাইতগণ, সাহাবায়ে কেরামগণ, শহীদগণ এবং আল্লাহর ওলিগণ আমাদের চিন্তার উর্ধ্বে। তাঁরা আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন, তাঁর বন্ধু হয়েছেন এবং অমরত্ব লাভ করেছেন।
আর মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করে ঈমান এনেছে। তাঁরা জন্ম থেকে ইন্তেকাল পযর্ন্ত আল্লাহর রাস্তায় ছিলেন এবং আজও তাঁরা কবরে ইবাদতের মধ্যই রয়েছেন উপরোক্ত কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা তাই বুঝতে পারি।
তাঁদের রওজা মোবারক ও মাজার শরীফ প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুসলমানদের ঈমানকে দৃঢ় করেছে, রহমত ও প্রশান্তি দান করেছে এবং সঠিক পথে চলতে সহায়তা করেছে।
আমরা সাধারণ মুসলমান মারা যাওয়ার পর আমাদের সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে সহীহ মুসলিমে হাদিস এসেছে— রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মানুষ মারা গেলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি ব্যতীত: (১) সাদকায়ে জারিয়া, (২) এমন জ্ঞান যেটি থেকে উপকার পাওয়া যায়, (৩) নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১৬৩১)
অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: “যখন তোমরা জান্নাতের বাগানের পাশ দিয়ে যাবে তখন সেখান থেকে গ্রহণ করো।” সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন: “ইয়া রাসূলাল্লাহ! জান্নাতের বাগান বলতে কী বোঝানো হয়েছে?”
তিনি বললেন: “যিকিরের মজলিস।” — (তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ৩৫১০; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১২৭০০)
এ থেকে আমরা শিক্ষা পাই, সাধারণ মুসলমানের কবরগুলো এমন হওয়া উচিত যেখানে বসে কোরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর যিকির করা যাবে। এ ধরণের পরিবেশ হলে তা হবে উত্তম সাদকাহে জারিয়া। কারণ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে—“যিকিরের মজলিস বেহেশতের বাগান।” সুতরাং, যদি আমাদের পিতা-মাতা কবরে অশান্তিতে থাকেন, তবে যিকির ও কোরআন খতমের মাধ্যমে তাঁরা বেহেশতের প্রশান্তি লাভ করবেন, ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু আজ আমরা লক্ষ্য করি, অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতার কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে না। কবর ভেঙে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এতে আমরা তাদের যথার্থ হক আদায় করতে ব্যর্থ হই। তাই “কবর পূজা” বা ‘বিদআত’ বলার পরিবর্তে কবর জিয়ারতের প্রকৃত সংস্কৃতি বজায় রাখা জরুরি।
আমাদের উচিত, পিতা-মাতার কবরগুলো এমনভাবে তৈরি করা যেখানে বসে কোরআন পাঠ করা যাবে এবং আল্লাহর জিকির করা যাবে। এ সংস্কৃতি অতীতে ছিল, এবং তা অব্যাহত থাকুক, যাতে আমরাও একদিন তার সুফল পেতে পারি।
-গোলাম মোস্তফা ফিচার্স রাইটার ও কলামিস্ট