রিয়া: লোক দেখানো ইবাদত ও শিরকের বিপদ

- প্রকাশঃ ০১:৪২:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
- / 9
ছবি: এআই / প্রজন্ম কথা
ইবাদত মুসলমানের জীবনের মূল প্রাণশক্তি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ যাবতীয় ইবাদত করা হয়। কিন্তু যখন ইবাদতে খাঁটি নিয়ত থাকে না, আর আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে মানুষের প্রশংসা অর্জনের উদ্দেশ্য প্রাধান্য পায়, তখন সেই ইবাদত আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য থাকে না। বরং তা হয়ে দাঁড়ায় ভয়ঙ্কর এক আত্মঘাতী পাপ—যার নাম রিয়া। ইসলাম এটিকে শিরকে আসগর বা ছোট শিরক বলে অভিহিত করেছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির আশঙ্কা করি, তা হলো ছোট শিরক।” সাহাবারা জানতে চাইলেন: “হে আল্লাহর রাসূল! ছোট শিরক কী?” তিনি বললেন: “রিয়া (লোক দেখানো)।” (সহিহ মুসলিম)
আবার অন্য এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে:
“যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে, সে শিরক করেছে। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য রোজা রাখে, সেও শিরক করেছে।” (আবু দাউদ)
এগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে যে ইবাদতে লোক দেখানো কোনো তুচ্ছ অপরাধ নয়; বরং এটি শিরকের অন্তর্ভুক্ত এবং ইবাদতের মূল ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
রিয়ার সংজ্ঞা:
রিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দেখানো। ইসলামী পরিভাষায় রিয়া হলো—ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে মানুষের প্রশংসা, সম্মান, মর্যাদা বা দুনিয়াবি স্বার্থ কামনা করা।
উদাহরণস্বরূপ—
১. কেউ যদি নামাজ পড়ে এই ভেবে যে, মানুষ তাকে নামাজি বলবে,
২. কেউ যদি দান করে এ আশায় যে, সমাজে দানশীল হিসেবে খ্যাতি পাবে,
৩. কেউ যদি কোরআন তিলাওয়াত করে মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য—
তাহলে সেই ইবাদত আর খাঁটি থাকে না। তা আল্লাহর দরবারে বাতিল হয়ে যায়।
কুরআনে রিয়ার নিন্দা:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে স্পষ্টভাবে রিয়ার নিন্দা করেছেন।
১. সূরা মাউন (আয়াত ৪-৬):
“অতএব ধ্বংস তাদের জন্য যারা নামাজ পড়ে, অথচ তারা তাদের নামাজে উদাসীন; যারা লোক দেখায়।”
২. সূরা বাকারা (আয়াত ২৬৪):
“হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের দান-খয়রাতকে রিয়া বা লোক দেখানো এবং কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে নষ্ট করো না।”
এগুলো প্রমাণ করে যে রিয়া শুধু নামাজেই নয়, বরং দান, সাদকা ও সব ধরনের ইবাদতকেও বিনষ্ট করে দেয়।
রিয়ার ভয়াবহতা:
রিয়ার ক্ষতি শুধু এতটুকুই নয় যে ইবাদত বাতিল হয়ে যায়, বরং এর ফলাফল পরকালে অত্যন্ত ভয়াবহ। মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা হলেও রিয়ার কারণে তা হয়ে যায় শিরক বা শিরকে আসগর। যা অত্যন্ত বিপদজনক এবং ভয়াবহ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“কিয়ামতের দিন প্রথম তিন শ্রেণির লোককে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে—
১. শহীদ, যে যুদ্ধ করেছিল লোকের চোখে বীর হবার জন্য।
২. আলেম বা কোরআন পাঠক, যে জ্ঞানার্জন করেছিল ও কোরআন শিখেছিল মানুষের প্রশংসার জন্য।
৩. দানশীল ব্যক্তি, যে দান করেছিল লোকজনের প্রশংসার উদ্দেশ্যে।
তাদের প্রত্যেককে বলা হবে: তুমি তো মানুষের কাছ থেকে যা চেয়েছিলে, তা পেয়ে গিয়েছ। আজ তোমার জন্য কিছুই নেই।”
(সহিহ মুসলিম)
এখানেই বোঝা যায়, রিয়া এমন এক ব্যাধি যা মানুষের দুনিয়ার খ্যাতি দিলেও আখিরাতের ধ্বংস ডেকে আনে।
রিয়ার সূক্ষ্ম রূপ:
রিয়ার অনেক সূক্ষ্ম রূপ রয়েছে, যা সাধারণত মানুষ টেরই পায় না। যেমন—
১. নামাজে সুন্দর কণ্ঠে কিরআত করা, যাতে অন্যরা প্রশংসা করে।
২. মসজিদে সামনের কাতারে দাঁড়ানো শুধু সম্মানের জন্য।
৩. বেশি দান করলেও মনে আশা থাকে, লোকজন প্রশংসা করবে।
৪. হজ পালন করলেও মনে বাসনা থাকে সুখ্যাতি।
এসবই রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কখনো কখনো রিয়ার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তও মিশে যায়, যাকে বলা হয় শিরকুল খফি (গোপন শিরক)। এ থেকে বাঁচার জন্য সর্বদা আত্মপর্যালোচনা, আত্মার পরিশুদ্ধতা জরুরি।
কেন রিয়া শিরকে আসগর?
শিরক মানে হলো আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা। সাধারণত মানুষ মূর্তি, দেব-দেবী বা অন্য শক্তিকে যেমন আল্লাহর সাথে শরিক করে, তেমনি রিয়ার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতপক্ষে মানুষের দৃষ্টি ও প্রশংসাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে শরিক করে। তাই ইবাদত এবং সৎকর্মসমূহকে রিয়ামুক্ত রাখা জরুরি।
আল্লাহ বলেন:
“আমি এমন অংশীদার থেকে অতি নিরপেক্ষ যে, কেউ যদি আমার সাথে অন্য কাউকে শরিক করে, আমি তাকে তার শরিকের কাছে ছেড়ে দিই।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস কুদসি)
অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতে যখন অন্যের প্রশংসা বা দৃষ্টি মিশে যায়, তখন আল্লাহ তা কবুল করেন না। বরং সে ইবাদত হয়ে যায় শিরকে আসগর।
রিয়ার কারণ:
মানুষ কেন রিয়াতে লিপ্ত হয়? কিছু কারণ হলো—
১. দুনিয়াবি সম্মান ও খ্যাতির লোভ।
২. মানুষের প্রশংসা অর্জনের প্রবণতা।
৩. আত্মগৌরব বা অহংকার।
৪. দুর্বল ঈমান—আল্লাহর সন্তুষ্টি যে সবচেয়ে বড় অর্জন, তা ভুলে যাওয়া।
রিয়া থেকে বাঁচার উপায়:
১. খাঁটি নিয়ত (ইখলাস): সব কাজ শুরু করার আগে অন্তরে দৃঢ় নিয়ত করতে হবে—এটি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
২. আল্লাহর মহত্ত্ব স্মরণ: সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ প্রশংসা দিলেও তা ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি চিরস্থায়ী।
৩. দোয়া: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শিখিয়েছেন:
“হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই, যেন অজান্তে শিরক না করি এবং জেনে-বুঝে করলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।”
(মুসনাদ আহমদ)
৪. গোপন ইবাদত: যতটা সম্ভব ইবাদতকে গোপন রাখা উচিত—যেমন নফল নামাজ, দান-খয়রাত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি।
৫. আত্মসমালোচনা: মাঝে মাঝে নিজের আমল বিশ্লেষণ করা—আমি কি আল্লাহর জন্য করছি, নাকি মানুষের জন্য?
আজকের সমাজে রিয়া:
আজকের যুগে রিয়ার নতুন রূপ দেখা যায়। অনেকে ইবাদত, দান-সদকা কিংবা হজ-উমরাহর ছবি প্রকাশ করে মানুষের প্রশংসা কুড়াতে চায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সওয়াবের কাজকেও প্রচারের বস্তু বানানো হয়। যদিও নেক আমল প্রচার করা সর্বদা রিয়া নয়, কিন্তু যদি উদ্দেশ্য মানুষের প্রশংসা হয়, তবে তা ভয়ঙ্কর শিরকে পরিণত হয়।
রিয়া ইবাদতের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও বিপজ্জনক ব্যাধি। এটি মানুষের অন্তরের আমলকে ধ্বংস করে দেয় এবং আল্লাহর দরবারে তাকে খালি হাতে দাঁড় করিয়ে দেয়। এজন্য প্রিয় নবী (সাঃ) রিয়াকে ছোট শিরক বলে সতর্ক করেছেন।
রিয়ার প্রতিকারঃ
রিয়া থেকে মুক্তির মূল পথ হলো অন্তরের পরিশুদ্ধতা বা আত্মশুদ্ধি। কেননা, রিয়া কেবল বাহ্যিক আচরণের ত্রুটি নয়—এটি অন্তরের এক সূক্ষ্ম ব্যাধি। এর চিকিৎসা শুধু জ্ঞান বা উপদেশে সম্ভব নয়; প্রয়োজন রুহানি ফয়েজের, যা একজন কামেল মুর্শিদের সোহবত ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এই রুহানি ফয়েজই অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রকৃত প্রেম জাগিয়ে তোলে। সেই প্রেমই অন্তরকে পবিত্র করে তোলে, আমলকে খাঁটি বানায়, আর রিয়ার বিষকে ধুয়ে দেয়।
এ বিষয়ে আয়াত এসেছে—“আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, সে-ই হিদায়াতপ্রাপ্ত। আর যাকে তিনি বিভ্রান্ত করেন, তুমি তার জন্য কোনো অভিভাবক বা পথপ্রদর্শক (মুর্শিদ) পাবে না।” — (সূরা আল-কাহফ ১৮:১৭)
মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেছেনঃ
“বলুন, যদি তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিজন, স্বজন, উপার্জিত ধনসম্পদ, মন্দার আশঙ্কায় সঞ্চিত ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পছন্দের আবাসভূমি তোমাদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো—আল্লাহ ফয়সালা নিয়ে আসা পর্যন্ত।” (সূরা আত-তাওবা: ২৪)
অতএব, অন্তরের পবিত্রতা ও রুহানি জাগরণই রিয়ার প্রকৃত প্রতিষেধক। যে অন্তর আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এঁর প্রেমে পূর্ণ, সেই অন্তরই রিয়ামুক্ত এবং ঈমানের সত্য আলোয় উদ্ভাসিত এবং একজন মুর্শিদ মুরিদকে সে পথেই পরিচালিত করেন।
যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে মানুষের প্রশংসা কামনা করে, সে প্রকৃত অর্থে নিজের নফসের দাসে পরিণত হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন—
“আপনি কি দেখেছেন, যে নিজের প্রবৃত্তিকে তার উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে?”
(সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ৪৩)
ইবাদতে রিয়া মূলত এ নফসীয় দাসত্বেরই প্রকাশ; যা ইখলাসকে বিনষ্ট করে এবং আমলকে প্রাণহীন করে ফেলে। এজন্য প্রয়োজন একজন কামেল মুর্শিদের সান্নিধ্য, যিনি মুরিদকে নফসের ফাঁদ থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করেন।
রিয়া এমন এক আত্মিক ব্যাধি, যা নিঃশব্দে আমলের অন্তরস্থ উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে দেয়। এর প্রতিকার শুধু উপদেশ বা জ্ঞানচর্চায় নয়; প্রয়োজন আত্মিক সাধনা ও সঠিক দিকনির্দেশনা। তাই একজন কামেল মুর্শিদের (পথপ্রদর্শক) সান্নিধ্য অপরিহার্য—যিনি আল্লাহর ফয়েজ ও নবী চরিত্রের আলোয় শিষ্যদের অন্তর জাগিয়ে তোলেন। তাঁর রুহানি ফয়েজেই অন্তরে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এঁর প্রেম জন্ম নেয়, অর্জিত হয় আত্মার পবিত্রতা। যা রিয়ার বিষকে ধুয়ে দেয় এবং আমলকে করে তোলে খাঁটি ও আল্লাহমুখী।
ওই অবস্থায় তার সকল কর্মকান্ড হয়ে থাকে মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য। প্রকৃত ইবাদতের প্রাণ তাই এই আত্মিক জাগরণেই নিহিত—যেখানে উদ্দেশ্য শুধু এক, আল্লাহর সন্তুষ্টি।
-গোলাম মোস্তফা- ফিচার্স রাইটার ও কলামিস্ট