মেট্রোর বিয়ারিং প্যাড পড়ে মৃত্যু: দায় এড়ানোর সুযোগ নেই কারও
- প্রকাশঃ ১০:২৩:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
- / 23
টাইলসের ফুটপাতে পড়ে আছে আবুল কালামের নিথর রক্তাক্ত দেহ। তার স্ত্রীর কান্না বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, আর শিশুটি বুঝতেই পারছে না কী হারিয়েছে | ছবি: প্রজন্ম কথা
“এই পদ্মা সেতু দিয়ে কেউ যাবেন না, ভেঙে পড়ে যাবে” একসময় এই বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তখন অনেকেই হাসলেন, কেউ তীব্র সমালোচনা করলেন, কেউ আবার ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন—‘দেশ এগোচ্ছে, আর তিনি ভয় দেখাচ্ছেন!’
পরে পদ্মা সেতু নির্মিত হলো ১২ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলন থেকে বেড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকায়। তবু আমরা খুশি—সেতুটি টিকে আছে, এখনো কোনো অংশ ভেঙে পড়েনি। এবং আমরা সবাইই চাই এটি অটুট থাকুক, কারণ এটি বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক।
কিন্তু সেই আত্মতৃপ্তির মাঝেই মনে করিয়ে দেয় অন্য এক বাস্তবতা—ব্যয়ের উদারতা, তত্ত্বাবধানে উদাসীনতা, এবং ‘যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে’—এই মনোভাবই যেন বড় প্রকল্পগুলোর স্থায়ী সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে।
ঢাকা মেট্রোরেল নিঃসন্দেহে আধুনিক বাংলাদেশের এক গর্বের প্রকল্প। হাজারো মানুষ প্রতিদিন এর সুবিধা নিচ্ছেন, সময় বাঁচাচ্ছেন। আমিও তাদের একজন। কিন্তু একজন সুবিধাভোগী হয়েও প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হচ্ছি—এই সুবিধার আড়ালে যদি অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির ছায়া থাকে, তবে সে অর্জন কতটা স্থায়ী?
দুর্নীতির দায়ে মৃত্যু, দায় কার?
মাত্র তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয়বারের মতো একই স্থানে মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজন পথচারীর মৃত্যু ঘটেছে। এই বিয়ারিং প্যাড ক্রয়ে দুর্নীতির আশঙ্কা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনাও হয়েছিল অনেক আগেই—গত বছরের সেপ্টেম্বরে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভালো মানের বিয়ারিং প্যাডের বদলে অধিক মূল্যে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে।
আজ সেই আশঙ্কাই সত্য হলো—একজন মানুষের প্রাণ গেল। কিন্তু ঘটনাটির দায় নিয়ে চলছে দোষারোপের রাজনীতি। অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে অভিযোগ ছোড়া হচ্ছে, অথচ প্রকল্প নির্মাণকালীন সময়ের দুর্নীতির দায় নিয়ে কেউ মুখ খুলছে না।
প্রশ্ন উঠছে—মাত্র তিন বছরের মাথায় কেন একই স্থানের বিয়ারিং প্যাড দুইবার খুলে পড়বে?
এটা কি নির্মাণমানের ব্যর্থতা নয়?
নাকি গুণগত দুর্নীতির ফল?
কিন্তু তার মানে এই নয় যে বর্তমান (ইউনুস) সরকারের কোনো দায় নেই।
তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে।
– কেনো তারা বিয়ারিং প্যাড ক্রয়ে সম্ভাব্য দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করতে পারল না?
– কেনো তারা বিকল্প নিরাপদ সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করল না?
– কেনো মেট্রোর পিলারগুলো পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেলো?
– কেনো মেট্রো স্টেশনের নিচ মানুষের মূত্রত্যাগ আর হকারদের আস্তানা হয়ে উঠল?
– কেনো মেট্রোর সিড়ির মুখ এবং কনকোর্স লেভেল পর্যন্ত ভিক্ষুকদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে গেল?
– কেনো প্রবেশপথ থেকে আনসার গার্ডদের সরিয়ে দেওয়া হলো?
– কেনো সিড়ি কিংবা পিলারের স্টিল কাঠামো ধুলো-ময়লায় কালো হয়ে আছে?
– কেনো এলিভেটর ও লিফটগুলো নিয়মিত বিকল থাকে?
– কেনো ইলেকট্রনিক গেটগুলো প্রায়ই অচল থাকে?
– কেনো এক বছরেও মেট্রোর কার্ড পাওয়া যায় না?
– কেনো কার্ড বিক্রির বুথগুলোতে কর্মচারী থাকে না?
– কেনো হঠাৎ মেট্রো বন্ধ হলে যাত্রীদের তথ্য জানানো হয় না?
– কেনো টিকিট কাটা যাত্রীদেরও টয়লেট ব্যবহারে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়?
– এই প্রশ্নগুলোর উত্তর শুধু ইউনুস সরকার নয়, আগের সরকারকেও দিতে হবে।
বিয়ারিং প্যাড দুর্নীতির দায় শেখ হাসিনা সরকারের, কিন্তু দুর্ঘটনার পর তদন্ত ও তদারকিতে উদাসীনতার দায় বর্তমান সরকারের। দু’পক্ষই দায়ী—এক পক্ষ নির্মাণকালীন দুর্নীতিতে, অন্য পক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যর্থতায়।
অতএব এখনই প্রয়োজন— স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন, প্রকল্পের প্রতিটি উপকরণের মান যাচাই প্রকাশ, দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে তাৎক্ষণিক কার্যকর পদক্ষেপ, এবং দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ তদারকির নতুন কাঠামো।
–জাফর সাদিক, সময় টিভি-এর সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক এবং টক শো হোস্ট
মতামত লেখকের নিজস্ব





























