ঢাকা ০৪:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুলাই উইমেন্স ডে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: শহীদ ১০ নারী, স্মৃতির ঝঞ্ঝার মধ্যে অগ্নিকন্যাদের গল্প

প্রজন্ম কথা ডেস্ক
  • প্রকাশঃ ০৭:৩১:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
  • / 6

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ নাঈমা সুলতানার ডায়েরিতে ছিল জন্মদিনের চমকের গল্প। অথচ সেই জন্মদিন আর আসেনি ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই মাত্র ১৫ বছর বয়সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় উত্তরার বাসায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এই কিশোরী। ২৫ জুলাই ছিল তার জন্মদিন। আজ দেশের অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুলাই স্মৃতি উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানমালা’র অংশ হিসেবে ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ স্লোগানে ‘জুলাই উইমেন্স ডে’ পালন করছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের গেজেটে এ পর্যন্ত ৮৪৪ জন শহীদের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ নারী ১০ জন। বয়স ৬ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে — এদের চারজনই ১৮ বছরের নিচে।

শহীদ ১০ নারীর মধ্যে ৭ জন রাজধানী ঢাকায়, ২ জন নারায়ণগঞ্জে এবং ১ জন সাভারে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন নিজ বাসার বারান্দা বা ছাদে। কেউ কেউ রাস্তায়। প্রথম গুলিবিদ্ধ হন গৃহকর্মী লিজা আক্তার। তাঁর মৃত্যু হয় ঘটনার তিন দিন পর। আর প্রথম মৃত্যু ঘটে শিক্ষার্থী নাঈমার। একই দিনে গুলিবিদ্ধ হন মায়া ইসলাম, রিয়া গোপ ও নাছিমা আক্তার। সর্বশেষ মৃত্যু হয় শাহিনুর বেগমের তিনি ২২ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে ১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

জুলাই আন্দোলনের আরেক মর্মান্তিক নাম রিয়া গোপ বয়স মাত্র ছয়। নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটির চারতলা ভবনের ছাদে খেলতে গিয়ে বাবা দীপক কুমারের কোলে গুলিবিদ্ধ হয় সে। ছয় দিন পর ২৪ জুলাই ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। একমাত্র সন্তান হারিয়ে দীপক ও বিউটি ঘোষের ঘর এখন নিস্তব্ধ।

নাঈমার মা আইনুন নাহার জানান, মেয়ের জন্মদিন নিয়ে সে কী উচ্ছ্বসিত ছিল, এখন সেই আনন্দের মাসই হয়ে গেছে শোকের মাস। নাঈমার মতোই অসংখ্য স্বপ্ন থমকে গেছে ২০২৪ সালের জুলাইতে।

রামপুরার মেরাদিয়ার বাসিন্দা মায়া ইসলাম (৬০) ১৯ জুলাই নেমেছিলেন ছেলেকে আইসক্রিম কিনে দিতে। সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে প্রাণ যায় মায়ের, ছেলেও গুরুতর আহত। সেই শিশু বাসিত খান মুসা এখনও সিএমএইচে চিকিৎসাধীন এক পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বাবা মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আম্মু নাই, ছেলের জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে।’

নাছিমা আক্তার, লিজা আক্তার, সুমাইয়া আক্তার, শাহিনুর বেগম, নাফিসা হোসেন মারওয়া কারও মৃত্যু ঘটেছে ছাদে, কারও বারান্দায়, কেউ আবার ঘরের ভেতরে। মিরপুরে জানালা দিয়ে গুলি ঢুকে শহীদ হন মেহেরুন নেছা। বিজয় মিছিল শেষে বাসায় ফিরেই জীবন থেমে যায় তাঁর।

নাফিসা হোসেন মারওয়া পরীক্ষার ফল দেখতে পারেননি মৃত্যুর দেড় মাস পর তাঁর এইচএসসি রেজাল্ট বের হয়, ফলাফল জিপিএ ৪.২৫। মায়ের কষ্ট দূর করার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সুমাইয়া আক্তারের আড়াই মাস বয়সী সন্তান সোয়াইবা এখন বড় হচ্ছে নানির কাছে ‘মা’ বলতে শিখেছে, অথচ মাকে চিনতে শেখেনি।

শহীদ পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ ও সরকারি সহায়তা পেয়েছে ঠিকই, তবে প্রিয়জন হারানোর ক্ষত কোনো ভাতা বা ঘোষণায় মুছে যায়নি। শোকাহত পরিবারগুলোর একটিই প্রত্যাশা যে সরকারই আসুক, শহীদদের মর্যাদা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন যেন নিশ্চিত হয়।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা ছিলেন অন্যতম শক্তি। তাঁদের সাহসী অংশগ্রহণ গোটা জাতিকে প্রেরণা দিয়েছে।’

আন্দোলনের বারান্দা, ছাদ আর জানালার গল্পগুলো বলে দেয় এই গণ-অভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক নয়, এ এক অজস্র ঘরের, অসংখ্য মায়ের, স্ত্রীর, মেয়ের রক্তে লেখা ইতিহাস।

তথ্য: প্রথম আলো

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”

শেয়ার করুন

জুলাই উইমেন্স ডে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: শহীদ ১০ নারী, স্মৃতির ঝঞ্ঝার মধ্যে অগ্নিকন্যাদের গল্প

প্রকাশঃ ০৭:৩১:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ নাঈমা সুলতানার ডায়েরিতে ছিল জন্মদিনের চমকের গল্প। অথচ সেই জন্মদিন আর আসেনি ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই মাত্র ১৫ বছর বয়সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় উত্তরার বাসায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এই কিশোরী। ২৫ জুলাই ছিল তার জন্মদিন। আজ দেশের অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুলাই স্মৃতি উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানমালা’র অংশ হিসেবে ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ স্লোগানে ‘জুলাই উইমেন্স ডে’ পালন করছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের গেজেটে এ পর্যন্ত ৮৪৪ জন শহীদের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ নারী ১০ জন। বয়স ৬ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে — এদের চারজনই ১৮ বছরের নিচে।

শহীদ ১০ নারীর মধ্যে ৭ জন রাজধানী ঢাকায়, ২ জন নারায়ণগঞ্জে এবং ১ জন সাভারে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন নিজ বাসার বারান্দা বা ছাদে। কেউ কেউ রাস্তায়। প্রথম গুলিবিদ্ধ হন গৃহকর্মী লিজা আক্তার। তাঁর মৃত্যু হয় ঘটনার তিন দিন পর। আর প্রথম মৃত্যু ঘটে শিক্ষার্থী নাঈমার। একই দিনে গুলিবিদ্ধ হন মায়া ইসলাম, রিয়া গোপ ও নাছিমা আক্তার। সর্বশেষ মৃত্যু হয় শাহিনুর বেগমের তিনি ২২ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে ১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

জুলাই আন্দোলনের আরেক মর্মান্তিক নাম রিয়া গোপ বয়স মাত্র ছয়। নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটির চারতলা ভবনের ছাদে খেলতে গিয়ে বাবা দীপক কুমারের কোলে গুলিবিদ্ধ হয় সে। ছয় দিন পর ২৪ জুলাই ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। একমাত্র সন্তান হারিয়ে দীপক ও বিউটি ঘোষের ঘর এখন নিস্তব্ধ।

নাঈমার মা আইনুন নাহার জানান, মেয়ের জন্মদিন নিয়ে সে কী উচ্ছ্বসিত ছিল, এখন সেই আনন্দের মাসই হয়ে গেছে শোকের মাস। নাঈমার মতোই অসংখ্য স্বপ্ন থমকে গেছে ২০২৪ সালের জুলাইতে।

রামপুরার মেরাদিয়ার বাসিন্দা মায়া ইসলাম (৬০) ১৯ জুলাই নেমেছিলেন ছেলেকে আইসক্রিম কিনে দিতে। সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে প্রাণ যায় মায়ের, ছেলেও গুরুতর আহত। সেই শিশু বাসিত খান মুসা এখনও সিএমএইচে চিকিৎসাধীন এক পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বাবা মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আম্মু নাই, ছেলের জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে।’

নাছিমা আক্তার, লিজা আক্তার, সুমাইয়া আক্তার, শাহিনুর বেগম, নাফিসা হোসেন মারওয়া কারও মৃত্যু ঘটেছে ছাদে, কারও বারান্দায়, কেউ আবার ঘরের ভেতরে। মিরপুরে জানালা দিয়ে গুলি ঢুকে শহীদ হন মেহেরুন নেছা। বিজয় মিছিল শেষে বাসায় ফিরেই জীবন থেমে যায় তাঁর।

নাফিসা হোসেন মারওয়া পরীক্ষার ফল দেখতে পারেননি মৃত্যুর দেড় মাস পর তাঁর এইচএসসি রেজাল্ট বের হয়, ফলাফল জিপিএ ৪.২৫। মায়ের কষ্ট দূর করার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সুমাইয়া আক্তারের আড়াই মাস বয়সী সন্তান সোয়াইবা এখন বড় হচ্ছে নানির কাছে ‘মা’ বলতে শিখেছে, অথচ মাকে চিনতে শেখেনি।

শহীদ পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ ও সরকারি সহায়তা পেয়েছে ঠিকই, তবে প্রিয়জন হারানোর ক্ষত কোনো ভাতা বা ঘোষণায় মুছে যায়নি। শোকাহত পরিবারগুলোর একটিই প্রত্যাশা যে সরকারই আসুক, শহীদদের মর্যাদা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন যেন নিশ্চিত হয়।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা ছিলেন অন্যতম শক্তি। তাঁদের সাহসী অংশগ্রহণ গোটা জাতিকে প্রেরণা দিয়েছে।’

আন্দোলনের বারান্দা, ছাদ আর জানালার গল্পগুলো বলে দেয় এই গণ-অভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক নয়, এ এক অজস্র ঘরের, অসংখ্য মায়ের, স্ত্রীর, মেয়ের রক্তে লেখা ইতিহাস।

তথ্য: প্রথম আলো

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”