ঢাকা ১১:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিয়ম মেনেও নিরাপত্তাহীন: কাঠামোগত ব্যর্থতায় নাগরিক জীবনের করুণ চিত্র

সাফা মল্লিক । নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশঃ ০২:০৯:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
  • / 8

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে এখন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিয়ম মেনে জীবন যাপন করলেও নিরাপদ থাকা যেন ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। রাস্তায় হাঁটা, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, কর্মস্থলে যাওয়া কিংবা পরিবারসহ বাইরে খেতে যাওয়া—সবই আজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করার মতো কাজ।

সম্প্রতি একের পর এক দুর্ঘটনা, প্রশাসনিক গাফিলতি ও বিচারহীনতার বাস্তবতা নাগরিকদের এক গভীর শঙ্কার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—এই দেশে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নিচ্ছে?

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোয় প্রতিদিন ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা—যেগুলোর অনেকগুলোই ছিল প্রতিরোধযোগ্য। খোলা ড্রেন, অনিরাপদ নির্মাণ, বৈধতা-বিহীন গ্যাসলাইন ও নিয়ম না মানা যান চলাচল, যেন একেকটি চলন্ত মরণফাঁদ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ হাজার মানুষ। তবে শুধু সড়কে নয়, নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে, বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে কিংবা ভবন ধসে প্রাণ হারিয়েছেন আরও অনেক মানুষ।

সবচেয়ে আলোচিত একটি ঘটনা—মাইলস্টোন কলেজে একটি পুরনো প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ক্লাসে থাকা শিক্ষার্থীদের হতাহত হওয়ার ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে—এমন একটি যুদ্ধবিমান, যেটি জাদুঘরে থাকার কথা, সেটি কিভাবে জনবহুল এলাকায় উড়ানো হয়?

নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে নারী ও শিশুদের জীবনে। গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র কিংবা এমনকি নিজ বাসাবাড়ির কাছেও নারীরা নিরাপদ নয়।
মানবাধিকার সংগঠন আসক-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অন্তত ১,২০০ নারী। বাস্তবতা আরও ভয়াবহ, কারণ অধিকাংশ ভুক্তভোগী মুখ খুলেনই না। আর যারা অভিযোগ করেন, তাদের অনেকেই পান না ন্যায়বিচার।

শিশুদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। রাস্তার পাশে খেলা করতে গিয়ে খোলা গর্তে পড়ে মৃত্যু, স্কুলে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা বাসার সামনের রাস্তায় গাড়ির চাপায় প্রাণ হারানো এখন যেন সংবাদপত্রের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠে প্রতিবাদ, আসে শোকবার্তা ও আলোচনার ঝড়।
কিন্তু যা আসে না, তা হলো দায়ীদের শাস্তি। প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা, প্রভাবশালীদের প্রভাব এবং অপর্যাপ্ত তদন্তের কারণে অনেক অপরাধী থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

নিহতদের পরিবারগুলো বছরের পর বছর লড়াই করেও বিচার পায় না, এক সময় ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে সব ছেড়ে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল অব্যবস্থাপনার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতারই প্রতিচ্ছবি।

নিয়ম মেনেও যদি কেউ নিরাপদ না থাকেন, তাহলে আইন ও সচেতনতার মূল্য কোথায়?
কোনো একটি ইট, একটি বৈদ্যুতিক তার, একটি গর্ত বা একটি ব্যবস্থাগত গাফিলতিই যদি একটি প্রাণ কেড়ে নিতে পারে—তাহলে এদেশে নাগরিকের জীবনের মূল্য কোথায় দাঁড়ায়?

এ প্রশ্ন শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর নয়—এ প্রশ্ন এখন গোটা জাতির।

আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম—যেখানে নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপ ঝুঁকিপূর্ণ, আর নিরাপত্তা কেবল নীতিমালার কাগজে সীমাবদ্ধ?

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”

শেয়ার করুন

নিয়ম মেনেও নিরাপত্তাহীন: কাঠামোগত ব্যর্থতায় নাগরিক জীবনের করুণ চিত্র

প্রকাশঃ ০২:০৯:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশে এখন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিয়ম মেনে জীবন যাপন করলেও নিরাপদ থাকা যেন ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। রাস্তায় হাঁটা, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, কর্মস্থলে যাওয়া কিংবা পরিবারসহ বাইরে খেতে যাওয়া—সবই আজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করার মতো কাজ।

সম্প্রতি একের পর এক দুর্ঘটনা, প্রশাসনিক গাফিলতি ও বিচারহীনতার বাস্তবতা নাগরিকদের এক গভীর শঙ্কার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—এই দেশে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নিচ্ছে?

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোয় প্রতিদিন ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা—যেগুলোর অনেকগুলোই ছিল প্রতিরোধযোগ্য। খোলা ড্রেন, অনিরাপদ নির্মাণ, বৈধতা-বিহীন গ্যাসলাইন ও নিয়ম না মানা যান চলাচল, যেন একেকটি চলন্ত মরণফাঁদ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ হাজার মানুষ। তবে শুধু সড়কে নয়, নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে, বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে কিংবা ভবন ধসে প্রাণ হারিয়েছেন আরও অনেক মানুষ।

সবচেয়ে আলোচিত একটি ঘটনা—মাইলস্টোন কলেজে একটি পুরনো প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ক্লাসে থাকা শিক্ষার্থীদের হতাহত হওয়ার ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে—এমন একটি যুদ্ধবিমান, যেটি জাদুঘরে থাকার কথা, সেটি কিভাবে জনবহুল এলাকায় উড়ানো হয়?

নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে নারী ও শিশুদের জীবনে। গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র কিংবা এমনকি নিজ বাসাবাড়ির কাছেও নারীরা নিরাপদ নয়।
মানবাধিকার সংগঠন আসক-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অন্তত ১,২০০ নারী। বাস্তবতা আরও ভয়াবহ, কারণ অধিকাংশ ভুক্তভোগী মুখ খুলেনই না। আর যারা অভিযোগ করেন, তাদের অনেকেই পান না ন্যায়বিচার।

শিশুদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। রাস্তার পাশে খেলা করতে গিয়ে খোলা গর্তে পড়ে মৃত্যু, স্কুলে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা বাসার সামনের রাস্তায় গাড়ির চাপায় প্রাণ হারানো এখন যেন সংবাদপত্রের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠে প্রতিবাদ, আসে শোকবার্তা ও আলোচনার ঝড়।
কিন্তু যা আসে না, তা হলো দায়ীদের শাস্তি। প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা, প্রভাবশালীদের প্রভাব এবং অপর্যাপ্ত তদন্তের কারণে অনেক অপরাধী থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

নিহতদের পরিবারগুলো বছরের পর বছর লড়াই করেও বিচার পায় না, এক সময় ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে সব ছেড়ে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল অব্যবস্থাপনার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতারই প্রতিচ্ছবি।

নিয়ম মেনেও যদি কেউ নিরাপদ না থাকেন, তাহলে আইন ও সচেতনতার মূল্য কোথায়?
কোনো একটি ইট, একটি বৈদ্যুতিক তার, একটি গর্ত বা একটি ব্যবস্থাগত গাফিলতিই যদি একটি প্রাণ কেড়ে নিতে পারে—তাহলে এদেশে নাগরিকের জীবনের মূল্য কোথায় দাঁড়ায়?

এ প্রশ্ন শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর নয়—এ প্রশ্ন এখন গোটা জাতির।

আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম—যেখানে নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপ ঝুঁকিপূর্ণ, আর নিরাপত্তা কেবল নীতিমালার কাগজে সীমাবদ্ধ?

সর্বশেষ খবর পেতে অনুসরণ করুন- “প্রজন্ম কথা”