ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী মিতার দুর্গাপূজা–কেন্দ্রিক চিত্রকর্ম ঘিরে বিতর্ক

- প্রকাশঃ ০৪:১৩:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ অক্টোবর ২০২৫
- / 41
শাড়ি, সূর্য ও ত্রিশূল: প্রতীকের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা | ছবি: প্রজন্ম কথা
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত একটি চিত্রকর্ম নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী মিতা মেহেদীর আঁকা এই ছবিতে দেখা যায়, এক দেবীসদৃশ নারীমূর্তি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ত্রিশূল হাতে সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত অসুরকে বধ করছেন। চারপাশে সবুজ পাহাড়, মাঝখানে রক্তের স্রোত, পেছনে লাল সূর্য এবং পাহাড়ি জুমঘর।
শিল্পীর উদ্দেশ্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বার্তা দেওয়া হলেও, ছবির প্রতিটি প্রতীক এখন তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
মিতা মেহেদীর ফেসবুক পোস্ট | ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
শাড়ির রঙ:
দেবীর শরীরে সাদা-সবুজ-নীল রঙের শাড়ি। সমালোচকেরা বলছেন, এই রঙ পাহাড়ি রাজনৈতিক সংগঠন UPDF বা KNF-এর পতাকার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার অন্য পক্ষ বলছে, রঙের ব্যবহার শিল্পীর কল্পনা, যা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক না-ও হতে পারে।
চারুকলার অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক বলেন, শিল্পী হয়তো রঙের সামঞ্জস্য খুঁজছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো বহুসংবেদনশীল সমাজে প্রতিটি রঙ একটি রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক পাঠ তৈরি করে। তাই এখানে শিল্পীর সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
পাহাড়ি গবেষক রুমানা চাকমা ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁর ভাষায়, পাহাড়ি মানুষের পতাকা হোক বা না হোক, এই রঙগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত। শাড়িতে এই রঙের ব্যবহার আমাদের ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতিরই প্রতিফলন।
ত্রিশূল:
নারীমূর্তির হাতে ত্রিশূল। এটি দুর্গাপূজার অন্যতম ধর্মীয় প্রতীক, যা উত্তর ভারতের শৈলীতে প্রচলিত। কিন্তু পাহাড়ি সমাজে দেবী বা ত্রিশূলের কোনো স্থান নেই।একজন পাহাড়ি সংগঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের সংগ্রামে দেবীর উপস্থিতি নেই। এখানে আমাদের নারীরা প্রতিরোধ করে নিজেদের শক্তিতে, বাইরের কোনো দেবী পাঠানো হয় না। এই প্রতীক আমাদের বাস্তব ইতিহাসকে আড়াল করছে।
তবে শিল্প সমালোচক এহসানুল কবীরের মতে, ত্রিশূল এক ধরনের সার্বজনীন প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। শিল্পী হয়তো দেবী নয়, বরং নারীর শক্তিকে প্রতীকায়িত করেছেন।
সূর্য:
পেছনে উদীয়মান সূর্য বাংলাদেশের পতাকার লালের তুলনায় ভিন্ন। কেউ বলছেন এটি গেরুয়া আভা বহন করছে, যা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতীকী রঙের সঙ্গে মিলে যায়।
জনপ্রিয় অনলাইন একটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য তার এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী মিতা মেহেদী সেনাবাহিনীকে অসুর বানিয়েছে তার দুর্গাপূজার চিত্রকর্মে। এই বাম পোগতিশীলরা নিজেরাই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে নেমে গেছে। এরাই ধর্মব্যবসায়ী। শেইমলেস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সরল বলেন, স্বাধীনতার সূর্য সবসময় লাল রঙের প্রতীক। এখানে সূর্যের গেরুয়া আভা অন্য রাজনৈতিক প্রতীকের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। এতে শিল্পীর বার্তা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
রক্তনদী:
ছবির সবচেয়ে আলোচিত অংশ হলো পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা রক্তের স্রোত। প্রশ্ন উঠছে—এটি কার রক্ত? সেনাবাহিনীর, নাকি পাহাড়ি মানুষের? ঢাকার শিল্পসমালোচক মুনতাসির আরেফিন বলেন, এই অনির্দিষ্টতা ছবিকে শক্তিশালী করে, আবার বিভ্রান্তিও তৈরি করে। দর্শক ভাবতে বাধ্য হন—এই রক্ত কার?
পাহাড়ি অনুপস্থিতি:
চিত্রে দেখা যায় পাহাড়, জুমঘর, রক্ত, দেবী- কিন্তু নেই পাহাড়ি মানুষ।
গবেষক মনীষা দেওয়ান বলেন, আমাদের সংগ্রামকে প্রতীকে তুলে ধরতে গিয়ে আমাদের অস্তিত্বই বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি প্রতীকী শূন্যতা তৈরি করেছে। বাইরের দেবী এসে আমাদের রক্ষা করছেন- এটি এক ধরনের ‘মেসায়ানিক ন্যারেটিভ’, যা আমাদের বাস্তবতাকে ছোট করে।
শিল্পীর উদ্দেশ্য:
শিল্পী মিতা মেহেদী সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও, তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন যে ছবিটি মূলত প্রতীকী প্রতিবাদ। একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বলেন, মিতা বোঝাতে চেয়েছেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীশক্তির প্রতিরোধ। তিনি কারও ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীকে আঘাত করতে চাননি।
বিশ্লেষণ:
চিত্রকর্মটি শিল্পীর দৃষ্টিতে প্রতিবাদের ভাষা হলেও, ভিন্ন প্রতীকের ব্যবহারে তা হয়ে উঠেছে বিতর্কিত। শাড়ির রঙ, ত্রিশূল, সূর্যের আভা এবং সেনাবাহিনীকে অসুররূপে চিত্রিত করা- সব মিলিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক।
একজন সাংস্কৃতিক কর্মী মন্তব্য করেন, শিল্পীর ক্যানভাসে যে প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে, তা হয়তো সৎ। কিন্তু প্রতীকের ভেতর দিয়ে তৈরি হওয়া বিভাজন আবার নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। শিল্প এভাবেই আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়।
এখন প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- এটি কি নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিল্পীর প্রতিবাদী কণ্ঠ, নাকি প্রতীকের ভেতর নতুন বিভাজন তৈরির সূত্রপাত?