গণভোটের রায় উপেক্ষা করে সিলেট ছেড়ে কীভাবে করিমগঞ্জ ভারতের অংশ হলো?

- প্রকাশঃ ০৭:০৮:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
- / 35
১৯৪৭ সালের দেশভাগের ইতিহাসে সিলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সিলেটের একটি মহকুমা করিমগঞ্জ যা এখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত, এক সময় ছিল সিলেটের অংশ। কিন্তু দেশভাগের সময় ঘটে যায় এক চমকপ্রদ মোড়। গণভোটে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার পক্ষে রায় এলেও করিমগঞ্জ রয়ে যায় ভারতে। আজও এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে রহস্য এবং বিতর্কের শেষ নেই।
সুনামগঞ্জ, করিমগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ মিলিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক গণভোট। প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষের অংশগ্রহণে ‘কুড়াল’ প্রতীক নিয়ে জয় পায় পূর্ব পাকিস্তানপন্থিরা, যা ৫৬.৫৬% ভোট। এই বিজয়ের ফলে সিলেট জেলার পুরো অংশই পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) যুক্ত হওয়ার কথা ছিল।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন হলো। দেশভাগের দায়িত্বে থাকা স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ, যিনি ভারতবর্ষ সম্পর্কে একেবারে অপরিচিত ছিলেন, তার তদারকিতে গঠিত সীমান্ত নির্ধারণ কমিশন এ গণভোটের ফলাফল উপেক্ষা করে ১২ আগস্ট ১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ লাইন প্রকাশ করেন। এতে করিমগঞ্জসহ সাড়ে তিন থানা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই সিদ্ধান্তে মুসলিম লীগ ও পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ হতবাক হন। বিতর্ক এখনো আছে—র্যাডক্লিফ কি কারসাজি করেছিলেন ভারতীয় নেতাদের সাথে? এই প্রশ্নের জবাব এখনো অজানা, কিন্তু ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠায় এ নিয়ে বহু আলোচনা ও গবেষণা রয়েছে।
তৎকালীন করিমগঞ্জের এসডিপিও এম এ হক (পরবর্তীতে বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী) দেশভাগের পরে এক সপ্তাহ পর্যন্ত করিমগঞ্জকে পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। প্রতিদিন অফিসে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করতেন এবং সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ নবাব আলীর কাছে সামরিক সহায়তা চেয়ে বারবার বার্তা পাঠাতেন।
তবে প্রতীক্ষিত সহায়তা এল না। সপ্তম দিনে, ভারতীয় বাহিনী করিমগঞ্জে প্রবেশ করলে, তিনি বাধ্য হয়ে পতাকা নামিয়ে ফেলেন এবং করিমগঞ্জ ছেড়ে সিলেটে ফিরে আসেন।
এম এ হক স্মৃতিচারণে বলেন, প্রতিদিন আমি অপেক্ষায় থাকি—এই বুঝি ফোর্স এলো। কিন্তু আসে না। একদিন, দুদিন… সাতদিন চলে গেল। অবশেষে ভারতীয় বাহিনী চলে এলো। আমি তখন নিরুপায়।
এই ঘটনার মাধ্যমে করিমগঞ্জ, রাতাবাড়ি, পাথরকান্দি—সবই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এখনো অজানা, কেন সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ নবাব আলী কোনো সহায়তা পাঠাননি র্যাডক্লিফ লাইনের এই ‘অদ্ভুত’ সীমা-নির্ধারণ নিয়ে আজও গবেষণা হয়, প্রশ্ন ওঠে, ইতিহাসে পুনর্মূল্যায়নের দাবি ওঠে। একটি গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, সেটি ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যায় এক বিদেশি আইনজীবীর কলমের আঁচড়ে।