সুস্থ মা, সুস্থ প্রজন্ম: নিরাপদ মাতৃত্বে সামগ্রিক উদ্যোগ জরুরি

ফিচার

আজ ২৮ মে, আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য দিবস। বাংলাদেশে দিনটি ‘বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৮৭ সাল থেকে দিবসটি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বসহকারে উদযাপন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য—‘নিরাপদ সন্তান প্রসব, মায়ের অধিকার’—শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং একটি বাস্তব দাবি ও প্রয়োজনীয় সামাজিক অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ।

দিবসটি উপলক্ষে দেশের প্রতিটি জেলা হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে পালিত হচ্ছে ‘বিশেষ মাতৃস্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ’। এই আয়োজনে গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও এখনও বহু নারী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সামাজিক কুসংস্কার, দারিদ্র্য, অবহেলা এবং সেবার সীমিত প্রাপ্যতা—এই চারটি প্রধান কারণ মাতৃমৃত্যুর হার বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও প্রসূতি সেবাবিষয়ক জরিপ (BMMMS)-এর তথ্য অনুযায়ী, গর্ভাবস্থায় প্রায় ১৫% নারী নানা জটিলতায় ভোগেন এবং প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে প্রায় ৫১% মাতৃমৃত্যু ঘটে।

আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, মাত্র ২৬% নারী WHO নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তত চারবার প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণ করেন। ফলে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতার কারণে মা ও নবজাতকের জীবন দুটিই ঝুঁকির মুখে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ৫৯টি জেলা হাসপাতাল, ৬৮টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং ১৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতি সেবার ব্যবস্থা করেছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কর্মজীবী গর্ভবতী নারীদের জন্য কমপক্ষে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু বাস্তবে অনেক নারী—বিশেষ করে পোশাক শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা—এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গর্ভকালীন সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের চাপ তাদের জন্য মারাত্মক হতে পারে।

নিরাপদ মাতৃত্বের পথে প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে—বাল্যবিবাহ, কিশোরী মায়েদের অপুষ্টি, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, রক্তস্বল্পতা, এবং প্রশিক্ষণহীন দাইয়ের মাধ্যমে সন্তান প্রসব। ভুল চিকিৎসা কিংবা অজ্ঞতার কারণে অনেক নারী জন্ম দেন সন্তানকে, কিন্তু নিজের জন্য রেখে যান দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা, এমনকি প্রসব-পরবর্তী ফিস্টুলার মতো কঠিন রোগও।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG-3) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে ৭০ জনের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সামাজিক সচেতনতা, নারী স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ এবং কুসংস্কারমুক্ত মনোভাব গড়ে তোলা জরুরি।

অতএব, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যৌথ প্রচেষ্টায়। শুরু থেকেই নারীর প্রতি যত্নবান হওয়া, সময়মতো চিকিৎসা ও পুষ্টির নিশ্চয়তা এবং গর্ভকালীন উপযুক্ত সহায়তা প্রদান করেই গড়ে তোলা সম্ভব একটি সুস্থ সমাজ ও প্রজন্ম।

নিরাপদ হোক মাতৃত্বের প্রতিটি মুহূর্ত—এই হোক আমাদের সর্বসম্মত অঙ্গীকার।

 

প্রতিবেদক:মো. জিসান রহমান