বিশ্বজুড়ে কুরবানির বৈচিত্র্য: আত্মত্যাগ, সংহতি ও সংস্কৃতির এক ভিন্ন বার্তা

- প্রকাশঃ ০৩:০৫:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ জুন ২০২৫
- / 57
ঈদুল আযহা মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব, যা আত্মত্যাগ, সহমর্মিতা ও মানবিক সংহতির এক অনন্য বার্তা বহন করে। কোরবানির এই ঈদ বিশ্বজুড়ে পালিত হলেও প্রতিটি অঞ্চলে তা ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে একটি স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে। কোথাও কোরবানির পশু উট, কোথাও গরু বা ছাগল; কোথাও আবার প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইন কোরবানিই হয়ে উঠেছে সময়ের দাবিতে জনপ্রিয় মাধ্যম।
সৌদি আরব: পবিত্রতা ও ব্যবস্থাপনার মডেল
হজের কেন্দ্রবিন্দু সৌদি আরবে ঈদুল আযহা উপলক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরবানির আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। হজ পালনকারীরা মিনায় সরকার অনুমোদিত ‘Adahi Project’-এর আওতায় নির্ধারিত স্লটার হাউজে লক্ষাধিক পশু জবাই করেন। হিমায়িত করে সেই মাংস বিশ্বের দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি, পরিবেশ সুরক্ষা এবং হালাল প্রক্রিয়ায় সৌদি আরব একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
ইন্দোনেশিয়া: সহভাগিতার উৎসব
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ‘Qurban Berbagi’ নামে পরিচিত যৌথ কোরবানির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সাতজন মিলে একটি গরু বা ছাগল কোরবানি দেওয়ার প্রচলন অত্যন্ত জনপ্রিয়। স্থানীয় মসজিদ এবং বিভিন্ন এনজিও স্বচ্ছতার সঙ্গে কোরবানির সংগ্রহ, জবাই ও বিতরণ সম্পন্ন করে। রাজধানী জাকার্তাতেই ২০২৩ সালে ১২ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘কেবায়া কুরঙ্গ’ ও ‘বাজু কোকো’ পরিধান করে পুরুষ-নারী ঈদ উদযাপন করেন।
তুরস্ক: পারিবারিক ঐক্যের প্রতিচ্ছবি
তুরস্কে কোরবানির আয়োজন পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ। পশু কেনা থেকে শুরু করে নাম রাখা, যত্ন নেওয়া সবকিছুতেই পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মাংস ভাগাভাগি করা ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনের পরিচায়ক। দেশটির রেড ক্রিসেন্ট ‘Kızılay’ ২০২৪ সালে ৩৬টি দেশে কোরবানির মাংস বিতরণ করেছে।
নাইজেরিয়া: ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত
আফ্রিকার এই বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে ঈদুল আযহা ধর্মীয় উৎসবের বাইরেও একটি সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়। মুসলিম ও খ্রিস্টান প্রতিবেশীরা একে অপরের বাড়িতে গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঈদের আগে পশুর হাটগুলো জমে ওঠে, গরুর দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। শহর ও গ্রাম—উভয় জায়গাতেই পশু জবাই শেষে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে মাংস ভাগাভাগি করা হয়।
মরক্কো ও মিসর: উট কোরবানির ঐতিহ্য ও রন্ধনসংস্কৃতি
উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে আজও উট কোরবানির প্রচলন রয়েছে। কোরবানির আগেই পশুকে গোসল করিয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এই অঞ্চলে ঈদের দিন তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন ‘টাজিন’, ‘মানসাফ’, ‘ফাত্তার’। ফিতরা ও মাংস বিতরণে সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। ঈদ এখানে ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও পারিবারিক আনন্দের উপলক্ষ।
ইউরোপ ও আমেরিকা: আইন মেনে বিকল্প আয়োজন
অমুসলিম দেশগুলোতে কোরবানি করতে হয় নির্ধারিত স্লটার হাউজে। ব্যক্তিগতভাবে পশু জবাই নিষিদ্ধ। তাই বহু প্রবাসী মুসলিম নিজ দেশে অনলাইন কোরবানি দিয়ে থাকেন। ইসলামিক রিলিফ, মুসলিম হ্যান্ডস, Penny Appeal-এর মতো সংস্থাগুলো বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে প্রবাসীদের হয়ে কোরবানি সম্পন্ন করে থাকে।
উপমহাদেশ: আবেগ ও বাস্তবতার মিশেল
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ঈদের বড় আকর্ষণ কোরবানির হাট। দরদাম, পশু নির্বাচন, নাম রাখা, ট্রাকে করে আনা—সবই ঈদের উত্তেজনার অংশ। তবে অতিরিক্ত মূল্য, দক্ষ কসাইয়ের অভাব এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা জনদুর্ভোগ তৈরি করে।
চীন: সীমিত আয়োজনে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ
চীনের জিনজিয়াং ও নিংজিয়া প্রদেশে মুসলিমদের জন্য সরকারি ছুটি এবং পশু কোরবানির সুযোগ রাখা হয়। এখানে ভেড়া কোরবানি দেওয়া হয়, আর ঈদের দিন তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘জিয়াং’। ঈদের সম্মানে ওই দিন টোল মওকুফ করা হয়।
বিশ্বজুড়ে অনলাইন কোরবানি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্ল্যাটফর্ম-
-
বাংলাদেশ: QurbaniBazaar, AmarQurbani
-
পাকিস্তান: MeatOne, Qurbani Online
-
ইন্দোনেশিয়া: GoQurban, ShopeeQurban
-
আন্তর্জাতিক: Islamic Relief, Muslim Hands
এছাড়া প্রবাসীরা ঈদের সময় নিজ দেশে ফিরে পরিবারসহ কোরবানি দিয়ে থাকেন। এ ধারা ‘Qurbani Tourism’ নামে পরিচিত, যা প্রবাসীদের ঈদের আবেগকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
দেশভেদে প্রচলিত কোরবানির পশু
অঞ্চল/দেশ | প্রচলিত কোরবানির পশু |
---|---|
বাংলাদেশ, ভারত | গরু, ছাগল |
সৌদি আরব, কুয়েত | উট, ভেড়া |
তুরস্ক, ইরান | ভেড়া, ছাগল |
নাইজেরিয়া, সুদান | গরু, ভেড়া |
মরক্কো, মিসর | উট, গরু |
ইউরোপ ও আমেরিকা | ভেড়া (আইনগত বাধ্যবাধকতায় ছোট পশু) |
বিশ্বজুড়ে ঈদুল আযহার উদযাপনে রয়েছে ভিন্নতা, তবে বার্তাটি একই আত্মত্যাগ, মানবতা ও সংহতির জয়গান। ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন, প্রতিবেশীর সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সামষ্টিক আনন্দ ভাগাভাগির উৎসব এই ঈদ।
বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে কোরবানির এই বৈচিত্র্যময় আয়োজন হোক মানবিক মূল্যবোধ, আন্তঃধর্মীয় সম্মান ও শান্তির প্রতীক।
ফিচার: সংগীত কুমার