যুদ্ধ না করেও ‘জাতির পিতা’: শেখ মুজিবকে ঘিরে ইতিহাসের বিতর্কিত অধ্যায়

- প্রকাশঃ ০৪:০৩:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৫
- / 6
বিভিন্ন বই, সাক্ষাৎকার ও দলিলপত্রে উঠে এসেছে ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা | ছবি: শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে মতবিরোধ ও বিতর্ক। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, দলিলপত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য বলছে- শেখ মুজিব ছিলেন সাহসী। তার ছিল আকর্ষণীয় জ্বালাময়ী ভাষণ যা মানুষকে চরমভাবে আন্দোলিত করত। তবে রক্ত গরম করা ভাষনের সাথে তার কথার কোন মিল ছিল না। অন্যদিকে ক্ষমতা ও রাজনীতির কৌশলী খেলোয়াড়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব দেশকে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানিকরণের দিকে না নিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষমতা লাভের দিকে প্রবাহিত করেন। স্বাধীনতার পর নেতৃত্বের ধরণ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন আজও ইতিহাসবিদদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ তাকে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা বললে খুব খুশি হতেন কিন্তু এগুলো সমালোচনা শোনার সহনশীলতা তার মাঝে ছিল না।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না বলে ঐতিহাসিক দলিলে উল্লেখ আছে। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি কখনো পাকিস্তানপন্থী, কখনো ভারতপন্থী, আবার কখনো সোহরাওয়ার্দী বা ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন- যখন যার প্রয়োজন ছিল, তখন তার সমর্থন নিয়েছেন এবং প্রয়োজন ফুরালে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।
১৯৫৮ সালে মাত্র চার দিনের জন্য পাকিস্তানি সরকারের মন্ত্রী হওয়ায় তাঁকে ‘চোরাই মন্ত্রী’ আখ্যা দেওয়া হয় (সূত্র: আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর)।
বড় বড় বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি দানের ক্ষমতা ছিল কিন্তু সম্মতের ভিত্তিতে কাজ করা গুন ছিল না। (সংবিধান সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ)
ছয় দফা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন
১৯৬৬ সালে এসে, সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি নিজস্ব কৌশলে রাজনীতি পরিচালনা করার চেষ্টা করেন এবং সেই ধারাবাহিকতায় ছয় দফার ঘোষণা দেন। তবে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এ ঘোষণার বিরোধিতা করেন।
দুর্নীতির মামলা সহ একাধিকবার কারাবাসের পর, জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব ছয় দফার প্রস্তাব জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন। অনেকের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানের ইশারায়ই তিনি এই ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, ছয় দফার কোথাও পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সরাসরি কোনো ইঙ্গিত ছিল না। (সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ দলিলপত্র, ২য় খণ্ড)
শেখ মুজিবুর রহমান তার লিখিত বক্তব্যে বলেন—
আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আপনারা দেখিতেছেন যে আমার ছয় দফা দাবিতে একটিও অন্যায়, অসঙ্গত, পশ্চিম পাকিস্তানি-বিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব আমি করি নাই। বরং আমি যুক্তি ও প্রমাণ সহকারে দেখাইয়াছি, আমাদের এই সুপারিশ গ্রহণ করা হলে পাকিস্তান আরও শক্তিশালী হইবে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারণা পোস্টারের শীর্ষে লেখা ছিল— “পাকিস্তান জিন্দাবাদ”। শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানপ্রীতির কারণে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হন। তিনি মনে করতেন, শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার সংগ্রামী নেতা হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ দলিলপত্র (২য় খণ্ড)-এর তথ্য অনুযায়ী, মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি আহ্বান জানান- মুজিব, তুমি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামে যোগ দাও। যদি আমেরিকা ও ইয়াহিয়ার সাথে কাজ করো, তবে আওয়ামী লীগের ধ্বংস অনিবার্য।
ভাসানীর এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, সে সময় শেখ মুজিব স্বাধীনতার পক্ষে সরাসরি আন্দোলনে যোগ দেননি। বরং তার রাজনৈতিক অবস্থান পাকিস্তানের ভেতরে থেকেই পরিবর্তন আনার দিকে বেশি ঝুঁকেছিল, যা ভাসানীর সঙ্গে তার মতপার্থক্যের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৭মার্চের আগে শেখ মুজিব
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের আগে শেখ মুজিবুর রহমান কখনোই প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি তোলেননি। তবে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনে অনেকের মনে সন্দেহ জন্মেছিল-আসলে মুজিব কী চান?
ভাষণের মূল দাবি ছিল জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। যদিও কিছু বক্তব্য মুক্তিকামী জনতার মনে শক্তি সঞ্চার করেছিল এবং কিছু বাক্য শুনে মনে হয়েছিল এটি স্বাধীনতার ঘোষণা। যেমন- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
ভাষণের পর বিদেশি গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
ভাষণের পর এক বিদেশি সাংবাদিক শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন—You mean independent?
উত্তরে মুজিব বলেন—“That I don’t mean.
তাজউদ্দীন আহমেদ—নেতাও পিতা-এর বর্ণনা অনুযায়ী, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমেদ (লেখকের ভাষায় “আব্বু”) স্বাধীনতার একটি লিখিত ঘোষণা এবং টেপ রেকর্ড তৈরি করেন। পরিকল্পনা ছিল, শেখ মুজিব এই ঘোষণায় সাক্ষর করবেন এবং তা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
তবে শেখ মুজিব আপত্তি জানিয়ে বলেন- এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে, পাকিস্তান আমাকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার করতে পারবে।
সেই সময় বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমেদও স্বীকার করেন- শেখ মুজিব কখনোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করেননি।
শেখ মুজিব না চাইলে ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন তাজউদ্দীন আহমেদ, জিয়াউর রহমান ও এম.এ. জি. ওসমানী। তবে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল মুজিব বাহিনীর সঙ্গে।
যদিও শেখ মুজিব সে সময় পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন, তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে “মুজিব বাহিনী” নামে একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেন, যা সমালোচকদের মতে অনেক সময় মুক্তিযুদ্ধের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত “মুজিব বাহিনী” ও তাজউদ্দীন গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। প্রথম বড় সংঘাত বাঁধে মুজিবনগর সরকার গঠন নিয়ে। (সূত্র: মূলধারা ’৭১)
মুজিব বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের দ্বন্দ্ব
মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়া এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ছিল “মুজিব বাহিনী” সদস্যদের প্রধান শর্ত। বাহিনীর সদস্যরা শপথনামা পাঠ করতেন, যেখানে তারা সরকারের প্রতি নয়, বরং মুজিব ও মনির প্রতি বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করতেন।
১৯৭১ সালের মে মাসে প্রকাশ্যে আলোচনা হতে থাকে যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” (RAW)-এর বিশেষ পরিকল্পনায় খুব শিগগিরই একটি বিশেষ বাহিনী গঠিত হবে। এই উদ্দেশ্যে “মুজিব বাহিনী”র জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। জুন মাস থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে তা ধাপে ধাপে নভেম্বরের প্রথম দিক পর্যন্ত চলে।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম দলের আত্মপ্রকাশের পর স্পষ্ট হয় যে এই বাহিনী পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী তথা বাংলাদেশ সরকারের কোনো ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব নেই।
বইয়ের ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠা অনুযায়ী- মুজিব বাহিনী এতটাই উশৃঙ্খল, অন্তর্ঘাতী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় যে, শীঘ্রই এই বাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডের অধীনে না আনা হলে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী পদত্যাগ করবেন বলে তাজউদ্দীনকে সরাসরি জানিয়ে দেন। সব দ্বন্দ্ব ও বিভক্তির মধ্যেও তাজউদ্দীন আহমেদ, জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী এবং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
স্বাধীনতার পর “মুজিব বাহিনী” চলে যায় “র” এর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে এবং বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নেয়। এভাবে, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও শেখ মুজিব “জাতির পিতা” উপাধি পান এবং বাস্তবে অঘোষিত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের একনায়কতন্ত্র
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান একবারও মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লেখ করেননি। বরং যুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন-তাজউদ্দীন আহমেদ, এম.এ.জি. ওসমানী প্রমুখ-তাদের ধীরে ধীরে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন। এই সময় মোট ৪৩ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
শেখ মুজিব স্বাধীনতার পরেও পাকিস্তানপ্রেমী মনোভাব বজায় রাখেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি পাকিস্তানের ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। “মুজাইক অফ মেমোরি” বইতে উল্লেখ রয়েছে, যুদ্ধের পুরো নয় মাস জেল থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে শেখ মুজিব ও ডঃ কামাল একজন মেজরের বাসায় ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে শেখ মুজিব ও তার পরিবারকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সকল ধরনের সহায়তা প্রদান করেছিল।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা- যুদ্ধের সময় সজীব ওয়াজেব জন্মগ্রহণ করেন এবং তাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। একইভাবে, যুদ্ধকালে শেখ মুজিবের বাবা অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে গোপালগঞ্জ থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়।
মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে একজন স্বাধীনতাবিরোধীকে উপরে তুলে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করা হলে, প্রকৃত ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি হয়ে যায়।
“সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি” বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী—স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গবন্ধু হিসেবে শেখ মুজিব চমৎকার হলেও স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন তুলনামূলকভাবে দুর্বল। ক্ষমতা গ্রহণের পর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের তিনি কঠোরভাবে শায়েস্তা করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রক্তি বাহিনী আইন ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাস করা হয়। আইনটির উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনী যাতে কখনোই শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারে, এবং এই বাহিনী গঠন করা হয় দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য।
১৯৭৩ সালের ভোট
১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবের শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষের কারণে নির্বাচনে মানুষ প্রথমবারের মতো জাসদকে ভোট দেয়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ভোটের ফলাফল জালিয়াতির মাধ্যমে জাসদের জয় ছিনিয়ে নেন।
“সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গে” বইয়ে নির্বাচনের বর্ণনা অনুযায়ী-
নির্বাচনের ফলাফল বেতার ও টিভিতে প্রচার শুরু হওয়ার পর দেখা যায়, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কয়েকজন নেতা কিছু নির্বাচনী এলাকায় পরাজিত হচ্ছেন। তখন সরকারী মিডিয়া কিউ ব্যবহার করতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় প্রচার কমিটিকে বাদ দিয়ে গণভবনের কন্ট্রোল রুম থেকে ফলাফল প্রচারের দায়িত্ব নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাকে জোরপূর্বক বিজয়ী করার জন্য ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। এছাড়া, সকল ব্যালট বক্স ছিনিয়ে নিয়ে নতুন ব্যালট পেপার ভর্তি করে কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা হয়, যাতে ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য নিশ্চিত করা যায়। এই ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতারণার একটি উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে নথিভুক্ত হয়।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো বিরোধী দলের নেতাকে অপহরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। চারটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার মধ্যে ভোলার ডক্টর আজহারউদ্দিন ছিলেন একজন শক্তিশালী প্রার্থী। মুজিব তাকে অপহরণ করে নিয়ে যান, এবং ওই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
ভোট চুরি ও ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের এমপিরা লাগামহীন দুর্নীতির মাধ্যমে দেশকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেন। ১৯৭৪ সালে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যদিও আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা তখন সম্পূর্ণ বেহেস্তের অবস্থায় ছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের সমালোচনা করলে তার ওপর নির্যাতন চালানো হতো। উদাহরণস্বরূপ, কবি রফিক আজাদ যখন শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে “ভাত দে হারামজাদা” কবিতা লিখেন, তখন তাকে জেলে পাঠানো হয়।
বিদেশি সাংবাদিকরা মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মানুষ খাবার পাচ্ছে না?” উত্তরে মুজিব বলেন- এ সবই গুজব। আমরা ফ্রিতে মানুষকে খাবার দিচ্ছি। তাই মাত্র ২৭ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে। তা না হলে কয়েক মিলিয়ন মানুষ মারা যেত।
আন-অফিসিয়ালি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে দুই থেকে তিন লাখ মানুষ মারা যান।
দুর্ভিক্ষ ও সরকারের ব্যর্থতার কারণে সারা দেশ তখন মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই সময় তিনি সতর্কভাবে মন্তব্য করেন= আমাদের যে অবস্থা, আগামী নির্বাচনে আমরা ২৫–৩০টি আসনের বেশি পাবো না। তখন জামাত ও অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জোট বেঁধে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষে শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করবে। (সূত্র: বই—রাজনীতির তিন কাল)
বাকশাল
শেখ মুজিব ক্ষমতায় থাকতেই জোর করে বাকশাল (এক নেতা, এক দল, এক দেশ) গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে বাকশালের বিরোধিতা যারা করেছিলেন, তাদের অবস্থা ভয়াবহ হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এই সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
বাকশালের বিরোধিতা করার সময় তাজউদ্দীন আহমেদ মন্তব্য করেছিলেন-
“মুজিব ভাই, এজন্যই কি আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছি? যেভাবে দেশ চলছে, আপনি থাকবেন না, আমরা থাকবো না, দেশ চলে যাবে রাজাকার ও আল বদরের হাতে।”
সংসদে শেখ মুজিব ঘোষণা দেন যে, বাকশালের বিরোধিতা করলে তাদেরকে জবাই করে টুকরা টুকরা করে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হবে। এইভাবে ক্ষমতার লোভে তিনি সংসদ, সংবিধান, আইন, বিচার ও শাসনের সবকিছুকে কুক্ষিগত করে দেশকে এক নরকে পরিণত করেছিলেন।
অনেকেই প্রশ্ন করেন- শেখ মুজিব যদি ভালো না হতেন, তাহলে পাকিস্তানি সরকার তাকে এতদিন জেলে রাখত কেন? দীর্ঘ সময় জেল খাটলেই কি কেউ জাতির পিতা হয়ে যায়?
নিশ্চিতভাবেই শেখ মুজিব একজন সাহসী নেতা ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতার কারণে বারবার জেলে যান, এবং এই সাহসের কারণে মানুষের কাছ থেকে তিনি ভালোবাসা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি পান। তবে, সাহস ও সততা সবসময় একই জিনিস নয়। সাহস ছিল তার রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশ, কিন্তু তার পরবর্তী একনায়কতন্ত্র ও ক্ষমতার লোভের সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।