জুলাই নারী দিবসে সাহসী কণ্ঠ
নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন: জুলাই বিপ্লবের অগ্নিকন্যা

- প্রকাশঃ ০৫:০৩:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
- / 24
নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন | ছবি: সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের এক নতুন বাঁক। দীর্ঘ সময়ের জমে থাকা ক্ষোভ, বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশের অগণিত শিক্ষার্থী, যুবক-যুবতী একসঙ্গে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। সেই সময়ে শত শত নারী যেমন রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছেন নারীর সাহসিকতা কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি এই প্রজন্মকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন।
অনেকেই হয়তো জানেন না, আন্দোলনের আগে নাফসিন ছিলেন একদমই প্রচারবিমুখ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের পড়াশোনাই ছিল তার মূল পরিচয়। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের চলমান রাজনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণ আর ক্ষমতার দাপট সবই তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য করে।
এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট তার চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন, চুপ থাকলে আর চলবে না। সেই নাড়া থেকেই রাজপথের প্রথম স্লোগান-
স্বৈরাচার আর নয়, জনগণের অধিকারই হবে আমাদের মূল দাবি!
নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন | ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
রাজপথ মানে শুধু স্লোগান নয়। পুলিশের বাধা, টিয়ারশেল, জলকামান সবকিছু পেরিয়ে নাফসিন দিনের পর দিন কুড়িল বিশ্বরোড, যমুনা ফিউচার পার্ক ও বসুন্ধরা এলাকায় অবস্থান করেছেন। তার চারপাশে ভীত, দ্বিধাগ্রস্ত সহপাঠীরা যখন নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চেয়েছে, নাফসিন তখন তাদের হাত ধরে নিয়ে গেছেন মূল মিছিলে।
তাকে অনেকে “অগ্নিকন্যা” নামে ডাকতে শুরু করে। কারণ রাজপথে তার উপস্থিতি মানেই নতুন সাহস। সেই সময়ের এক সহযোদ্ধার কথায়, ও যখন মাইক হাতে দাঁড়ায়, ভয় নামের শব্দটাই হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের রাজপথের চিত্র কখনোই একা একা দেশের মধ্যে আটকে থাকেনি। আন্দোলনের সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চোখ পড়েছিল নাফসিনের ওপর। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু সংস্থা তার ছবি, বক্তব্য আর স্লোগান ছড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক মহলে।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ দেশজুড়ে চলমান ‘বাংলা ব্লকেড’ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবৈধ বলপ্রয়োগ করেছে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে | ছবি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
একজন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসা—এটা যে কোনো নারীর জন্যই সাহস আর দায়বদ্ধতার নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট—দেশের ইতিহাসে এক নতুন দিন। দীর্ঘমেয়াদি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। এই দিনটিকে অনেকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবেও উল্লেখ করেন। নাফসিন সেদিনও ঘরে ফেরেননি।
তার ভাষায়, এই বিজয় কোনো দলের একার নয়, পুরো জনগণের। এখনো অনেক লড়াই বাকি। মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার আর প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে।
কেউ কেউ ভেবেছিলেন, আন্দোলনের পর নাফসিন হয়তো কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। এখনো তিনি কোনো দলীয় ব্যানারে যুক্ত নন। নিজেকে পরিচয় দেন দেশের সচেতন নাগরিক আর শিক্ষার্থী হিসেবে। তার বিশ্বাস, দল নয় মানুষের একতা আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই বড় শক্তি।
০২ জুলাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাইয়ের নীরব প্রতিবাদ | নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন | ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নাফসিন বারবার বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে সরব থেকেছেন। সম্প্রতি সময়ে ‘জুলাই কারও বাপের না’ শিরোনামের প্রতিবাদ জাতীয় গণমাধ্যমে উঠে আসে। তার মতে, কোনো রাজনৈতিক দল এককভাবে জুলাই মাসের অর্জন ও ঘোষণাপত্রকে নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। জুলাই কোনো দলে নয়, এটি সকলের যারা এই দেশের মানুষ, তারা-ই জুলাইয়ের মালিক। তিনি আরো বলেন, জুলাই কারও পারিবারিক সম্পত্তি নয়। এটি সর্বদলীয়, সর্বজনীন।
জুলাই নারী দিবসে শ্রদ্ধা
১৪ জুলাইকে ‘July Women Day’ হিসেবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার স্বীকৃতি দিয়েছেন যা নতুন প্রজন্ম পালন করতে শুরু করেছে। নাফসিনের মতো সাহসী কণ্ঠগুলোকে স্মরণ করে সবাই শপথ নেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে এটি শুধু দিবস নয়, এক ধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শপথ।
আজ নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন কেবল একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নন। তিনি নতুন প্রজন্মের সেই প্রতীক, যার কণ্ঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সুর। তার কথায়- যতক্ষণ অন্যায় থাকবে, ততক্ষণ প্রতিবাদ থামবে না। একদিন এই লড়াই, এই সাহস নতুন বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে।
প্রজন্ম কথা আজ তার সাহসিকতা আর দৃঢ়তার প্রতি সম্মান জানায়। জুলাই নারী দিবসে এই অগ্নিকন্যাকে প্রজন্ম মনে রাখবে অনুপ্রেরণার প্রদীপ হিসেবে।