“আমার ক্লাসরুম নেই, ল্যাব নেই, বাস নেই। আমরা কি শুধুই আইডি কার্ডধারী শিক্ষার্থী?”
কথাগুলো বলে থেমে যান জান্নাতুল ফেরদৌস, উত্তরা থেকে কবি নজরুল সরকারি কলেজে পড়তে আসেন প্রতিদিন। কণ্ঠে ক্ষোভ, চোখে ক্লান্তি, পায়ে প্রতিবাদের ছাপ। এই ক্ষোভ, ক্লান্তি আর প্রত্যাখ্যানই গত সোমবার রূপ নেয় রাজপথজুড়ে বিক্ষোভে।
রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবি নজরুল সরকারি কলেজ। শতবর্ষী ইতিহাসের ভারে যেটি গর্বিত, ঠিক ততটাই অবহেলায় জরাজীর্ণ আজ।
ছাত্রাবাস সংস্কার, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকট, নিরাপদ পরিবহনসহ মোট সাত দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা সোমবার সকাল থেকে ক্লাস বর্জন করে রাজপথে নামে।
বিক্ষোভকারীদের মতে, এটি কোনো হঠাৎ উত্তেজনা নয় – বরং বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অব্যবস্থাপনা, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমস্যাগুলো আড়াল করার এক নিষ্ঠুর ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবাদ।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান: মৃত্যুফাঁদে প্রতিদিন ক্লাস
রাজউকের তালিকাভুক্ত একটি ছয়তলা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে প্রতিদিন চলছে পাঠদান। নিচতলায় রিডিং রুম, দ্বিতীয় তলায় পাঠাগার এবং উপরের তলাগুলোতে শ্রেণিকক্ষ ও বিভাগীয় কার্যালয়।
ভবনের দেয়ালে ফাটল, ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে প্রায়ই। তবুও বিকল্প না থাকায় শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ক্লাস করছে।
এক শিক্ষার্থীর কণ্ঠে তীব্র হতাশা:
”ক্লাস করতে এসে যদি কেউ প্রাণ হারায়, দায় কে নেবে?”
শহীদ শামসুল আলম হল: আবাসন নয়, আতঙ্কের নাম
শতবর্ষ পুরনো, জরাজীর্ণ ছাত্রাবাসটিতে যেন লুকিয়ে আছে শত বঞ্চনার ইতিহাস। নেই বিশুদ্ধ পানি, নেই স্যানিটেশন, নেই কোনো নিরাপত্তা।
কখনো ছাদ খসে পড়ে মাথায়, কখনো বারান্দার রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে যায় শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রদল নেতা রোমান বলেন,
“ দীর্ঘদিন ধরেই বলছি, হলটা বসবাসের উপযোগী নয়। মেরামত হয়নি। বিভিন্ন সময় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। মাঝে মাঝেই সাদের ঢালায় খসে মাথায় আঘাত পায়,রেলিং ভেঙে পড়ে যায় কিন্তু প্রশাসন তেমন উদ্যোগ নেয়নি। কীভাবে থাকবে শিক্ষার্থীরা? আমরা চায় কলেজ প্রশাসন খুব তাড়াতাড়ি হল সংস্কার এর উদ্যোগ যেন নেয়।”
ক্লাসরুম সংকট: শিক্ষা হয় করিডোরে
শ্রেণিকক্ষের অভাবে অনেক বিভাগের শিক্ষার্থীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্লাস করেন। বিজ্ঞান ল্যাব নেই। রসায়ন-বায়োলজি এক্সপেরিমেন্ট চলে ‘বারান্দা ল্যাবে’। বিজ্ঞান ক্লাব থাকলেও সেটা সময়ের পরিবর্তনে দখল হয়ে গেছে।
কম্পিউটার ল্যাবের ছাদ চুইয়ে পড়ে পানি, সরাসরি কম্পিউটার যন্ত্রে।
বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মেহেদী বলে,
“এখানে গবেষণা নয়, চলছে যন্ত্রপাতির মৃত্যু। আমরা শেখার আগেই শেখার মাধ্যমটাই শেষ হয়ে যায়।”
শিক্ষক সংকট:
শিক্ষক সংখ্যা এতটাই কম যে, একজন শিক্ষককে একাধিক বিভাগের ক্লাস নিতে হয়। স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষককে মাধ্যমিকের ক্লাস নিতে হয়। সময়মতো কোর্স শেষ হয় না। সেমিনার, গবেষণা সবই কাগজে আটকে থাকে।
একজন স্নাতক শিক্ষার্থী বলেন,
“আমরা স্বপ্ন দেখি গবেষক হওয়ার, কিন্তু হাতে নেই উপকরণ, পাশে নেই গাইড।”
পরিবহন দুর্দশা: কোটি টাকা উঠে, চলে মাত্র ভাড়ায় ২টি বাস
১৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র দুটি ভাড়ায় চালিত বাস। সেটাও প্রায় সময় নষ্ট বা বন্ধ থাকে ।
এক বছরে প্রায় ১ কোটি টাকার বেশি পরিবহন ফি নেয়া হয়, কিন্তু কোথায় যায় সেই টাকা?
জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
“টাকা নিচ্ছেন, বাস নেই। তাহলে আমরা কী দিচ্ছি? উন্নয়নের নামে প্রতারণা? প্রত্যেক বছর ৬০০ করে টাকা দেই, সেই টাকা কোথায় যায়?”
অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান জানান, তারা চাইলেও বাস কিনতে পারেন না, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে।
বিক্ষোভ: শুধু দাবি নয়, ভবিষ্যতের প্রশ্ন
সোমবার সকাল ১১টা। কলেজের মূল ফটকে জমায়েত শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
স্লোগানে মুখর ক্যাম্পাস ছেড়ে মিছিল যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে। সেখানে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ১১ জন প্রতিনিধি ডিসির সঙ্গে কথা বলেন।
ডিসি আশ্বাস দিয়েছেন—৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে হল সংস্কার হবে এবং পরিবহন সমস্যা সমাধানে কলেজ প্রশাসনের সাথে কাজ করা হবে।
দাবি নয়, বাস্তবতা বদলের লড়াই
শিক্ষার্থীদের ৭ দফা দাবি:
১. জরাজীর্ণ হল সংস্কার ও নতুন হল নির্মাণ
২. ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নতুন আবাসিক ভবন
৩. সক্রিয় ও পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা
৪. শ্রেণিকক্ষ সংকট দূরীকরণে ভবন নির্মাণ
৫. ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ
৬. ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে আধুনিক ভবন নির্মাণ
৭. শিক্ষক সংকট দূরীকরণ
কলেজ নয়, যেন বঞ্চনার ক্যাম্পাস
এটি প্রথম আন্দোলন নয়। ২০১৯, ২০২১, ২০২৩ সালেও শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছিল। প্রতিবারই প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছিল। বাস্তবে? বদলায়নি কিছুই।
এই প্রতিবাদ শুধু নজরুল কলেজের নয়, এটি দেশের হাজারো সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীর স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।
”শিক্ষা কি অধিকার, নাকি লটারি? আমরা কবে পাব নিরাপদ ভবন, সুশৃঙ্খল ক্লাসরুম, সম্মানজনক পরিবহন ও গুণগত পাঠদান?”
যদি এসব প্রশ্নের জবাব না আসে, তাহলে এ আন্দোলন থামবে না বলছিলেন নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।
