মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জারিকৃত ৫৮ দিনের গভীর সমুদ্র মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা যেন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রসীমায় প্রতিদিন অসংখ্য ট্রলার যাচ্ছে গভীর সাগরে, চলছে মাছ ধরার অবাধ উৎসব।
চরমোন্তাজের মৎস্যঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞার সময় ঘাটে যে পরিমাণ ট্রলার থাকার কথা, বাস্তবে তার অর্ধেকও নেই। যে ক’টি ট্রলার ঘাটে রয়েছে, তার অনেকগুলোতেই বরফ, জাল, ডিজেল ও গ্যাস সিলিন্ডার তোলা হচ্ছে সবই সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি।
চরমোন্তাজের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ট্রলার মাঝি চাঁন মিয়া বলেন, আজ বিকেল বা কাল সকালে সাগরে যাবো। একেক ট্রিপে ২০-৩০ মণ মাছ পাই।
সঙ্গে থাকা জেলে মো. ইব্রাহিম জানান, টাইগার চিংড়ি, তুলার ডাডি, সাদা চিংড়ি, পোমা সবই ধরা হয়। কাঁকড়াও ধরি। গভীর সাগরে গিয়ে মাছ ধরি, যেখানে প্রশাসন আসতে পারে না।
একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে প্রতিবেদক নিজেই সাগরে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরার চিত্র। বুড়াগৌরাঙ্গ নদী পেরিয়ে চরহেয়ার সংলগ্ন মোহনায় পৌঁছে দেখা যায় ট্রলারভর্তি জেলে মাছ ধরছে। সোনারচরের দিকে যেতেও একই দৃশ্য অসংখ্য ট্রলার গভীর সাগরে মাছ ধরছে, প্রশাসনের কোনো উপস্থিতি নেই।
জানা যায়, সাগরে ধরা মাছ বিক্রি হয় মোহনায়, যেখানে ক্যারিংবোট ব্যবসায়ীরা এসে মাছ কিনে তীরে নিয়ে যান। আবার অনেক ট্রলার সমুদ্র থেকে ফিরে রসদ নিয়ে ফের যাত্রা করে গভীর সাগরে।
বাইলাবুনিয়ার জেলে দুলাল বলেন, বৃষ্টি আর বর্ষার সময়ে নৌ-পুলিশ কম আসে। সাগর শান্ত থাকলে তারা আসে স্পিডবোটে। ধরতে পারলে জরিমানা করে।
অনেকে সরাসরি স্বীকার না করলেও কিছু মাঝি ও জেলে জানান, ঘুষ দিয়েই সাগরে যাচ্ছেন তারা। এক জেলে বলেন, সব ম্যানেজ করেই সাগরে যাই। মালিক আর আড়তদার ম্যানেজ করে দেয়।”
‘মায়ের দোয়া’ ট্রলারের জেলে শাকিল সিকদার জানান, ম্যানেজ করেই নিয়মিত মাছ ধরতেছি। অবরোধ তো অনেকদিন চলতেছে।
চরমোন্তাজের জেলে জলিল হাওলাদার বলেন, টাইগারের জোবা চলছে, অনেক বোট সাগরে গেছে। গভীর সাগরে গেলে নেটওয়ার্কও থাকে না।
তাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারি খাদ্য সহায়তা সময়মতো মেলে না। অনেক প্রকৃত জেলে সহায়তা পান না, বরং তালিকায় থাকা অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তি সেই সুবিধা ভোগ করেন। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে সাগরে যাচ্ছেন।
রাঙ্গাবালী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সমুদ্রে যাওয়া সম্ভব হয় না। নিয়ম অনুযায়ী মৎস্য অফিসারসহ অন্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেই অভিযান চালানো হয়।
উপজেলা সামুদ্রিক মৎস্য কর্মকর্তা এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, যারা আইন অমান্য করে সাগরে মাছ ধরতে যাবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক-দুই বছরের জেল বা জরিমানা হতে পারে।
পরিবেশবিদ ও মৎস্য গবেষকরা বলছেন, নজরদারির অভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে না। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, নিষেধাজ্ঞার সুফল পেতে হলে নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে এবং গভীর সাগরে কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নয়তো সামুদ্রিক সম্পদের ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি হবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু ভারতের সঙ্গে মিল রেখে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করলেই হবে না। তদারকি দুর্বল হলে এর কোনও বাস্তব সুফল পাওয়া যাবে না।