মধ্যবিত্ত বললে ভুল হবে,নিম্নবিত্ত পরিবারের রাজকুমার আমি। পড়ালেখা বিষয়টিকে আমি আবিষ্কার করেছিলাম ক্লাস 3 তে। প্রাথমিক পর্যন্ত আমার পড়াশোনায় বড় বোনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা বেশি থাকলেও পরিস্থিতির পরিবর্তনে মাধ্যমিক থেকে বোনের সমর্থন ও সহযোগিতা কমতে শুরু করে। পড়ালেখায় বরাবরি ভালো ছিলাম রোল নং ১-৩ এর মধ্যে থাকা,এসএসসিতে ও এইচএসসি তে জিপিএ 5 পাওয়া,বোর্ড মেধাবৃত্তি পাওয়া,কলেজ টপার হওয়া,উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ মেধাবী ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী নির্বাচিত হওয়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণ সহ ছোটোখাটো বেশকিছু অর্জনই ছিল। পরিবার থেকে পড়ালেখা বন্ধ করে কাজে যাওয়ার প্রস্তাব আসে বহুবার। বেশ কিছু বার নিজেও চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পড়ালেখার প্রতি আমার একটা টান থাকায় আমি তা চুকিয়ে উঠতে পারিনি। পড়ালেখার খরচ সহ হাতখরচ কোনোটাই দেবার উপায় ছিল না আমার বাবার। তাই মাধ্যমিক থেকেই টিউশন, কুলির কাজ, দৈনিক মজুর সহ টুকটাক কাজ করে চলতে হতো। স্কুলে ও কলেজে স্যারদের ভালোবাসা,সাহস,সমর্থন আর সহযোগিতা কুড়িয়েছি বারংবার।
মাধ্যমিক শেষ করে এলাকার সরকারি কলেজে ভর্তি হই। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা সহ বেশকিছু পরীক্ষায় কলেজে ১ম হয়ে শিক্ষকদের সুদৃষ্টি পেয়েছিলাম। কলেজ জীবনে প্রাইভেট পড়ার দরকার পড়েনি আমার বরং নিজের বন্ধুদের নিজের পড়া একই বিষয় প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা নিয়ে খরচ চালাতাম আমি। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং থেকে কিছুটা আয় করতাম।আমার বাবা একজন কুলি। কিন্তু আমি আমার বাবার পেশাটাকে অনেক বড় করে দেখতাম।বাবার সাথে কাজ করে আমার টাই পড়া সাদা কলেজ ড্রেসটাকে ধুলো, ময়লা আর ঘামে ভিজিয়েছি বহুবার। রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে নিজের বন্ধু ও শিক্ষকদের সামনে বাবার সাথে কুলির কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করিনি আমি।
কলেজ জীবন সুন্দর মতো শেষ করলেও অভাব আর দারিদ্রের হাত ছানিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি সম্পর্কে ভাবার সুযোগ হয়নি আমার। স্বপ্ন ছিল অনেক বড় কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে আগানোর সাহস পাই নি। পরবর্তীতে শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় ফরিদপুরে এডমিশন কোচিং শুরু করি।
ফরিদপুরে মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু মেস,হোস্টেল,রুম এ নিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আমার। অর্থাভাবে ভালো রুম,পরিবেশ বা খাবার কোনোটাই জুটেনি আমার। একরকম ভাগ্য বিড়ম্বনার দরুন মেসের কিচেন এর সাথের ডাইনিং রুমেই থাকতে হয়েছিল আমাকে। রান্নার তেল মরিচের ঝাঁচ,খালার কাজ করার টুংটাং,ঠুস ঠাস শব্দ আর সবার অবাধ আসা-যাওয়ার পথেই ছৌট্ট এক ফাকে থাকতাম আমি। পড়াশোনার চাপে অসুস্থ হয়ে যেতাম প্রায়ই।সকালের চা,খেজুর কিংবা বিকালের নাস্তা কোনোটারই ব্যাবস্হা করতে পারিনি। তবে মেসের সকলের অফুরন্ত ভালোবাসা আর সমর্থন কুড়িয়েছিলাম।ফোকাস কোচিং শিক্ষকদের যত্ন আর অনুপ্রেরণা আমাকে বারবার এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে।
টাকার সমস্যা থাকায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফর্ম তুলতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে আমার প্রথম ভার্সিটির সিটে বসা। কিন্তু থাকা, খাওয়াসহ অন্যান্য সমস্যায় পড়ে যাওয়ায় দুর্ভাগ্যবশত ঢাবি ভর্তি পরীক্ষা আমার আশানুরূপ হয়নি। অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কিন্তু আশা ছাড়িনি আমি। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় অর্থাভাব,হতাশা,সংশয়,ঢাকা তে থাকার মত জায়গা না থাকা,পরিবারের অমত এসমস্ত প্রতিবন্ধকতার সাথে আমাকে লড়তে হয়।
জাবি আমার আমার জীবনের একটি অমূল্য উপহার। ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা ভালো হয়নি, আশানুরূপ রেজাল্ট হবে না তা বুঝে গিয়েছিলাম। কাঙ্ক্ষিত প্রস্তুতি থাকলেও তা ক্ষয় হতে শুরু করেছিল,পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম সব রকমের কাজকর্ম,পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এরপরই সুযোগ আসে আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চাওয়ার। পবিত্র শবে বরাতের দিন আল্লাহর কাছে চোখের পানির বিনিময়ে হাউমাউ করে কেঁদে একটি বিষয় চেয়েছিলাম যে আল্লাহ তুমি আমাকে আমার পরিশ্রমের ফল দাও,মানুষের মাঝে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার দাও। নিজের উপর বিশ্বাস ছিল যে পরিশ্রম আমার সাথে কখনো বেইমানি করবে না। জাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না তার পরেও মনের কোনে লুকিয়ে থাকা শেষ আশায় ছুটে গিয়েছিলাম জাবিতে।
দুর্ভাগ্যবশত ঢাকা শহরে আমার কোন আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব নেই যেখানে আমি গিয়ে পরীক্ষার আগের রাত্রে থাকতে পারি। তারপরেও আল্লাহর ওপর ভরসা করে ২৮ এ ফেব্রুয়ারি সকালে আমি জাবির উদ্দেশ্যে রওনা দেই। কিন্তু আমি নিজেও জানতাম না আমি কোথায় গিয়ে থাকবো। সারাদিন জ্যামে কাটে চারটা বাজে সাভারের বাসে উঠি।কিন্তু চিনতাম না জাহাঙ্গীরনগর। সাতটায় গিয়ে নামি সাভার বাসস্ট্যান্ডে সেখানে গিয়ে আমি নিঃসঙ্গ একা ক্লান্ত,ক্ষুধার্ত আর চিন্তাগ্রস্হ হতাশা নিয়ে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বহু লোক আমাকে দেখছিল কিন্তু আমি কোথায় যাব তার কোন জায়গা ছিল না আমার। ভেবেছিলাম সাভার বাসস্ট্যান্ডের মসজিদেই রাতটা কাটিয়ে দিব।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ফোনে একটি কল আসে আমার দুঃসম্পর্কের এক ভাই তার এক বন্ধুর ম্যাচে আমাকে থাকার জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমার পরিবার আমার জন্য থাকার কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি। কিন্তু আমার সেই ভাই আমার বিষয়ে জানত যে ঢাকায় আমার থাকার কোন জায়গা নেই তারপর আমি তার ফোন পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাসস্ট্যান্ডে। ঘণ্টা খানেক পর এক অপরিচিত ব্যক্তি আমাকে ফোন দিয়ে আমার কাছে আসে এরপর অলিগলির র মধ্য দিয়ে ২০ মিনিট হেঁটে একটি রুমে উঠি। সবকিছু অপরিচিত থাকলেও পরীক্ষা দেওয়ার কোনো প্রস্তুতি আমার ছিল না। যদিও বই আমার সাথে ছিল কিন্তু পড়ার প্রতি কোন আগ্রহ আমার ছিল না। সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি অপরিচিত ব্যক্তিদের সাথে থাকা ওখানে আমার সাথে আরো দুই জন ছিল যারাও জাবিতে পরীক্ষা দিবে। পেটে খুব ক্ষুধা কিন্তু খাবারের কথা বলতে পারছিলাম না। রাত এগারোটা নাগাদ খাওয়ার জন্য ডাকা হল কোনোমতে শাক ডাল দিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করলাম। কিন্তু বই পড়ার কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। সকাল দশটার দিকে আমরা বাস স্ট্যান্ড থেকে জাবিতে যাই। সকালের নাস্তা করার কোন আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে ছিল না। সাইনবোর্ডে লোকেশন দেখে সমাজবিজ্ঞান অনুষদে আমি আমার সিট খুঁজে ওখানে গিয়ে বসি। জাবি স্পেশাল কোনো প্রস্তুতি না থাকলেও নিজের প্রতি আর আল্লাহর উপর আমার একটি ভরসা ছিল যে আল্লাহ শেষ পর্যন্ত আমাকে অবশ্যই ভালো কিছু দিবে আলহামদুলিল্লাহ পরীক্ষা শেষ করে আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে জাবিতে অবশ্যই আমার ভালো একটি রেজাল্ট আসবে। সেদিনই বাড়ি চলে আসি খুব ক্লান্ত থাকার কারণে ঘুমিয়ে পড়ি। রাত বারোটায় রেজাল্ট প্রকাশিত হয় কিন্তু আমি রেজাল্ট দেখি নাই। সকাল দশটায় আমার সে দূর সম্পর্কের ভাই আমাকে ফোন দিয়ে জানায় আমি জাবি বি ইউনিটে ৫৫তম হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ আমার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হয়েছিল।
আইন বিষয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল আগে থেকেই,জাবিতে সেই সুযোগটি পেয়ে যাওয়ায় আমি আর পরীক্ষা দেই নি। আলহামদুলিল্লাহ্ আমার মতো অধম পাপী বান্দাকে আল্লাহ্ অনেক দিয়েছেন। আমার জন্মদাতা পিতা -মাতা, গুরুজন ও সকল শিক্ষা গুরুর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন আমি যাতে সরকারের বড় কোনো পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আমার বাবা -মায়ের স্বপ্ন পুরন করে দেশের সেবা করতে পারি।
আমির ফয়সাল
জাবি বি ইউনিট -৫৫তম